ক্যাম্পাস

আমার নানা রঙের দিনগুলি 

‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে  বাদল গেছে টুটি  আজ আমাদের ছুটি ও ভাই  আজ আমাদের ছুটি।’

রবি ঠাকুরের মেঘের কোলে রোদের মতোই আমার শৈশবের দিনগুলো ছিল হাজারো রজনীগন্ধায় আবৃত, শুভ্র, নির্মল ও নিষ্পাপ রঙিন। যেখানে ছিল না কোনো লুকোচুরি। শুধুই ছিল অবাধ স্বাধীনতা, হাজারো খুনসুটি, কত রঙিন ঘটনা, কত উচ্ছ্বাস ও কত উল্লাস। 

অথচ আজ আমার সোনার খাঁচায় মোড়ানো শৈশবের ঐ দিনগুলো আনাকে বিদায় জানিয়ে তার শূন্য আকাশে একাকার হয়ে গেছে। যখনই সেই দিনগুলো মনে পড়ে, বুকের ভেতর দুঃসহ এক জ্বালা অনুভূত হয়। যে আগুনে জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যায় আমার শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দু। 

‘মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে  মাকে মনে পড়ে, আমার মাকে মনে পড়ে।’

আমার শৈশবের দমকা দুষ্টুমি আর ডানা ঝাপটানো অবাধ দুরন্তপনার প্রতিটি মুহূর্তের সাক্ষী আমার মা। অ আ ক খ প্রতিটি বর্ণমালার সঙ্গে পরিচয়ের খুনসুটি মোড়ানো মুহূর্তের শামিল আমার মা। চাঁদ মামাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে দস্যিপনা মেয়েকে ঘুম পাড়ানোর ছন্দ আমার মায়ের। 

শৈশবে আমার আধো আধো কথা শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাওয়া ঐ মানুষটি আমার মা। মায়ের কাছে কারণে-অকারণে কতই না বায়না ধরেছি। এখন সেগুলো ভাবলে নিজের প্রতি আত্মাভিমান, লজ্জায়, অনুতাপে মাথা নুয়ে যায়। মা আজ খুব ছুঁয়ে দিতে মন চায় তোমার হৃদয়ের ভালোবাসায় মোড়ানো খোলা জানালার প্রতিটি কপাট। 

‘হাবুদের তালপুকুরে  বাবুদের ডালপুকুরে  সেকি বাস করলে তাড়া বলি থাম একটু দাঁড়া।’

নজরুলের ‘লিচুচোর’ যেন আমারই শৈশবকে উৎসর্গ করে লেখা। আমার অবাধ দুরন্তপনা আর অকৃত্রিম বন্ধুত্বের সূত্রপাত শৈশবেই। শৈশবের খোলা আকাশ এলোমেলো করে চলার নিত্যসঙ্গী আমার বন্ধুরা। তাদেরকে সঙ্গী করে হৈচৈ, আড্ডা, এ পাড়া, ও পাড়া ঘুরে বেড়ানো। পুকুর, ডোবা, নদীতে সাঁতারের প্রতিযোগিতা। নদী পাড়ের পলি মাটির মিষ্টি গন্ধে মুখ লুকিয়ে থাকতে কী যে ভালো লাগতো!

বৃষ্টিতে ভিজে কর্দমাক্ত হয়ে ফুটবল খেলা। আর রেফারির বাঁশির শব্দে মাঠের পর মাঠ দৌঁড়ে চলার যে উদ্যম এর সবই যেন আজ মাঠের ঐ কর্দমাক্ত কাদার মাঝে লেপটে গেছে। রঙিন ঐ দিনগুলো আজও আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে! 

‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে  ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।’

আষাঢ়ের কালো মেঘকে সামনে রেখে মায়ের ডাকাডাকি আর সঙ্গে দিনভর বিরতিহীন ঝমঝম বৃষ্টির মাঝে আমার টইটুম্বুর হয়ে যাওয়া, এ যেন আমার শৈশবের অবিশ্রান্ত এক বর্ষণের মহোৎসব। খুব মনে পড়ে মায়ের অবাধ্য মেয়ে হয়ে বৃষ্টি বিধৌত পথের দু’পাশ দিয়ে ছুটে চলার প্রতিটি মুহূর্ত। 

‘নীল আকাশে কে ভাসালো  সাদা মেঘের ভেলা; ও ভাই লুকোচুরি খেলা।’ 

আমার শৈশবের আকাশজুড়ে ছিল মেঘ আর রোদের মাখামাখি। একটু মেঘ, এক পশলা বৃষ্টি, এক ঝলক হাওয়া আবারও সোনালী রৌদ্দুর। শৈশবের এই সোনালী রৌদ্দুর আজ পরিণত হয়েছে খণ্ড খণ্ড কালো মেঘে। আর আমার লুকোচুরি পরিণত হয়েছে বিক্ষিপ্ত মেঘের প্রতিটি রাশিতে। যেগুলো আজ আমার অন্তরে বজ্রসম আঘাত করে চলেছে প্রতিনিয়ত। 

খুব মনে পড়ে শীতের সকালে লেপ-কাঁথাকে বিদায় জানিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে নিশ্চুপ পায়ে কুয়াশা ভেদ করে চলা সেই দিনগুলোর কথা। নির্মম শীতে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে থাকা আর বন্ধুরা মিলে গাছির চোখকে উপেক্ষা করা। তারপর খেজুরের তাজা রস চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ার মাঝে যে কতটা তৃপ্তি, তা বলে শেষ করা যায় না। আজও সেই স্মৃতি মনে বয়ে আনে এক অনাবিল প্রশান্তি। 

আমার শৈশবের হাজারো রঙিন স্মৃতির মাঝে মামা বাড়ি বেশি মনে পড়ে। স্কুল নেই, ক্লাস নেই, পরীক্ষা নেই, বাবার শাসন নেই, মায়ের বকুনি নেই, শিক্ষকের সঙ্গে দুষ্টুমির পুরস্কার কান ধরে ওঠবস নেই। আছে শুধুই আনন্দের জোয়ার। 

মামাতো ভাই-বোনদের সঙ্গে নৌকা ভ্রমণ। মাঠের বুক চিরে জলের উপর দিয়ে ভেসে যাওয়ায় সে যে কি আনন্দ! আর সুর করে একসঙ্গে গেয়ে ওঠা— ‘ও নদীরে, একটি কথা শুধাই তোমারে।  বলো কোথায় তোমার দেশ  তোমার নেই কি চলার শেষ! ও নদীরে...’

মামার বাড়ি মানেই অবাধ স্বাধীনতা। মামার বাড়িতে সেই কালবৈশাখী ঝড়ের কথা আজও মনে পড়ে। কালবৈশাখী আর আমাদের হৈচৈতে একাকার হয়ে যেত বাড়ির প্রতিটি প্রাঙ্গণ। আজও কালবৈশাখী এলে মনের অজান্তেই বলে উঠি— ‘ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ  পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ।’

জানি শৈশবের ঐ সোনাঝরা দিনগুলো আর ফিরে পাবো না। বন্ধুদের ডানা ঝাপটানো অবাধ দুরন্তপনায় আর শামিল হতে পারবো না। শিক্ষকের সেই ভালোবাসায় মোড়ানো শাসনগুলো আর ফিরে পাবো না। ফিরে পাবো দুর্বিষহ এক মৃত্যুযন্ত্রণা আর দু’চোখের জলে আবৃত সেই শৈশবের বন্ধুত্বের রঙিন স্মৃতিগুলোর মলিন ফ্রেম। তাইতো কবিগুরুর ন্যায় আমারও বারবার বলতে ইচ্ছে হয়—  ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না, রইল না  সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।’

 

লেখক: শিক্ষার্থী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।