ক্যাম্পাস

আমি ব্যর্থ স্বামী, ব্যর্থ বাবা

আমি একজন ব্যর্থ বাবা। আসলে আমি কোনো বাবাই নই। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। সেই কখন থেকে, তা প্রায় ১০টা থেকে এই মাচায় একা একা বসে আছি। এই ঈদের দিনে আমার কোনো কাজ নেই। 

ভাবছেন কেন থাকবে না? আজ তো আপনি মাংসের ছোট ছোট টুকরা করতে পারেন, আপনি না হয় চাপাতি দিয়ে হাড় কাটতে পারেন। কত কাজ? আর আপনি বলছেন আপনার কোনো কাজ নেই। 

হ্যাঁ, আমি একটা আশ্চর্য কথা বলে ফেলেছি। আমি একটু দূরে বসে থাকলেও হাড় কাটার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে কারা যেন আমার পাজরের হাড়গুলো গুড়িয়ে দিচ্ছে। 

-আমি আপনার কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। -কিছুই বুঝবেন না আপনি। বোঝার জন্য আমার অতীত শুনতে হবে।  -হ্যাঁ, বলুন শুনি। -আমি তখন ছোট। প্রথম কোরবানির ঈদ যখন বুঝতে পারি, তখন খুব কষ্ট পেলাম।  -কী আজব লোক তো আপনি! কষ্ট পাবেন কেন?  -বলছি শুনুন। আমি তখন বুঝতে পারলাম আমার বাবা বাকিদের বাবার মতো না। অন্যান্য বাবারা মাংস আনতে গেছে, আর আমার বাবা কোথায় যেন চলে গেছেন, মার মুখ শুকনো। বাবা যখন বাড়িতে ফিরলো, তখন রাত। মা জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় ছিলেন সারাদিন। বাবা কি বললো জানেন? - বলেন শুনি।  -বাবা বললো, ঈদ কেন থাকতে হয় সমাজে। ঈদ গরীবের জন্য দুঃখের, লজ্জার। কথাগুলো আমি তখন বুঝিনি। তবে এখন বুঝতে পারি। কেননা, আজ আমার ছেলেটা দূর সড়কে গিয়ে হাঁটছে, সে চুপচাপ। সে কেমন যেন আজকের ঈদের দিনটা উপভোগ করতে পারছে না। তার জন্য তো আমি দায়ী। আমি আমার সন্তানকে হাড় কাটা শেখাতে পারছি না৷ কীভাবে মাঝারি আকারের করে মাংসের টুকরা করতে হয়, তা শেখাতে পারছি না। 

আমি তো পারছি না কীভাবে চামড়াটা নিপুণভাবে আলাদা করতে হয়, তা শেখাতে। আমার স্ত্রী তো একটু তরকারির ঝোল আমার সামনে এনে বলতে পারছে না যে দেখোতো লবণ, ঝাল ঠিক আছে কি-না। হ্যাঁ, পাশের বাড়ির সবাই হয়তো একটু একটু করে মাংস দেবে। তবে সেখানে কত রকমের গরুর কত স্বাদের মাংস থাকবে, আর আমার স্ত্রী তাতেই হয়তো তরকারির স্বাদ টেস্ট করতেই ভুলে যাবে। হয়তো তার ইচ্ছেই হবে না তরকারিতে লবণ কিংবা ঝাল হয়েছে কিনা জানতে। তার জন্য তো আমি দায়ী। 

-ভাই, আপনি এত কষ্ট পাচ্ছেন কেন? কোরবানি তো সামর্থ্যবানদের জন্য।  -তাহলে আমি সামর্থ্যবান নই কেন? কেন আমার ছেলে অসহায়ের মতো দূরে দূরে হাঁটবে। কেন আমার সন্তানকে অন্য একজন দরদী গলায় করুন স্বরে বলবে, এই প্রিতম এইদিকে আয়। আমি তো বাবা। নিজের অপমান মানা যায়, তবে স্ত্রী-সন্তানের এই কষ্ট কী করে সহ্য হয়। 

আমি তাই দূরে একটা মাচায় বসে বসে আমার সন্তান-স্ত্রীর দুঃখ মাপছি। আর ভয় হচ্ছে, ওরা না আমায় অভিশাপ দিতে থাকে। তাই বলছি, আমি ব্যর্থ স্বামী, ব্যর্থ বাবা।

 

লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।