ক্যাম্পাস

অণুগল্প: স্বস্তি

কাশেম সাহেব কয়েক দিন ধরে অপেক্ষা করছেন একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টের। কিন্তু অপেক্ষা শেষ হচ্ছে না। ইচ্ছে করলে সার্চ দিয়ে দেখতে পারতেন, কিন্তু তাও করবেন না। বাঙালির এই ইগোটা থেকেই গেলো। ভাঙবে, তবু মচকাবে না। 

স্মার্ট ফোনটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করেন। ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে চোখ রাখেন, ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টগুলো চেক করেন। কিন্তু নিজে থেকে পাঠানোর আগ্রহ দেখান না। কাশেম সাহেবের এই স্বভাবটা সেই ছোটবেলা থেকেই। নিজের কষ্ট নিজেই বয়ে বেড়াবেন, কারো সঙ্গে শেয়ার করবেন না। এ নিয়ে বহুবার তাকে নানা ধকল পোহাতে হয়েছে। তারপরেও তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই।

- কি গো, কী ভাবছো? গিন্নীর কথায় কাশেম সাহেব সম্বিত ফিরে পান। - না, তেমন কিছু না। - ঈদ তো এসে গেলো, কোরবানির ব্যাপারে কিছু করলে না? - বলে রেখেছি, গরু পেলে গরু, না পেলে দু’টো খাশি কিনে ফেলবো। - তা কাকে বলে রেখেছো? কবে হবে? - বিশ্বাস রাখো, ভরসা রাখো। সময়মতো পেয়ে যাবে। - যাকে বলে রেখেছো, তাকে একটা ফোন দাও, আসপাশের সবাই তো যে যার মতো কিনে বিল্ডিংয়ের সামনে রীতিমতো প্রদর্শনী করছে। ছেলে বলছিল- - দাঁড়াও ফোন দিচ্ছি। কাশেম সাহেব মিরাজকে ফোন দেন - মিরাজ, কি হলো, গরু পেলে? - জি স্যার, আমি তো আপনাকেই ফোন দিচ্ছিলাম। কিন্তু ফোন ঢুকছে না। স্যার, আপনি কি একটু আসতে পারবেন? - কোথায়? - এই স্যার, আমার বাসার কাছেই। আজ রাতে এখানে কিছু গরু এসেছে। আমি দেখেছি। আপনিও স্যার দেখতে পারেন। ওরা হাটে তুলবে না। এখান থেকেই বিক্রি করবে। - কি বলো! ঘড়ি দেখেছো, এখন রাত ক’টা বাজে? এত রাতে যাওয়া যাবে না। সকালে যাবো কেমন? - আচ্ছা স্যার, এসে আমাকে ফোন দিয়েন। কাশেম সাহেব ফোনটা রেখে দিয়ে গিন্নীর দিকে তাকান। গিন্নী এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে কাশেম সাহেবের ফোনালাপ শুনছিলেন। আশ্বস্ত হয়ে হাসিমুখে ড্রয়িং রুমে চলে যান। কাশেম সাহেব আবারও ফেসবুকে মনোনিবেশ করেন। ম্যাসেঞ্জারে হাসান নক করছে। ক্রমাগত রিং হয়েই যাচ্ছে। কাশেম সাহেবের ইচ্ছে হয় না কলে এটেন্ড করতে। ধরলেই সেই একই প্রশ্ন, ‘কিরে, ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেলি?’

একবার, দু’বার, তিন বারের বার কাশেম সাহেবের মনে হয় হাসান অন্য কোনো কারণেও তো কল দিতে পারে। তিনি কলটা ধরেন। - হ্যাঁ, বল? - ব্যস্ত নাকি? কল ধরছিলি না যে? - গিন্নীর সঙ্গে কথা বলছিলাম। - এখনতো সারাদিনই একসঙ্গে। কথা শেষ হয় না? - সাংসারিক কথাবার্তা কি শেষ হয় মামু? একটার সঙ্গে যে অন্যটা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে। তো বল, তোর কী খবর, কেন তুই-ই বা এতবার কল দিচ্ছিস? - দোস্তের খোঁজ পেলি? - তুই পেয়েছিস, তাতেই খুশি। আমার দরকার দেখছি নে। - কেন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসেনি? আমি তো ভাবলাম তোর সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে গেছে বলে আমাকে আর নক করছে না! - নারে আসেনি। হয়তো অন্য কোনোভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তাই এদিকের কথা মনে নেই। - তা কেন হবে, ওর পক্ষ থেকেই তো আগ্রহ দেখলাম। তোকেই তো আগে ফোন দিয়েছিল। তোকে না পেয়েই না আমাকে! - তোর সঙ্গে তো লিংক হয়েছে, নক করে দেখ। - আচ্ছা দেখবো। ঈদে কি গ্রামে যাচ্ছিস? - না, এরমধ্যে যাবো কি রে? নদীর অবস্থা দেখেছিস? একে তো করোনা তার সঙ্গে বন্যাও জুটেছে। মানুষ কীভাবে যে বাঁচবে? - তা যা বলেছিস। শোন, প্রথম আলোতে ফরিদপুরের দুই ভাইয়ের ফিচারটা পড়েছিস? কী সাংঘাতিক! - হ্যাঁ, দেখলাম। কিন্তু ওদের শেল্টারদাতা, গড ফাদারদের কী হবে? তারা তো আরও বেশি প্রভাবশালী? - তা ঠিক। মনে হয় তারাও ধরা পড়বে। শুনলাম, ওপর মহলের গ্রিন সিগন্যালেই পুলিশ অ্যাকশনে গেছে। - তাহলে তো ভালোই। জনগণ স্বস্তিতে থাকবে। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দও মুখ খোলা শুরু করেছেন। মনে হয় না তারা পার পেয়ে যাবে।

- সাহেদের বিষয়টিও তাই। মনে হচ্ছে কোনোরূপ ছাড়া পাবে না! - সাহেদ ক্ষমতার কত কাছাকাছি ছিল খেয়াল করেছিস? একটা অর্ধ-শিক্ষিত মানুষ কত সহজেই মিডিয়া থেকে শুরু করে ক্ষমতাশীলদের কাছাকাছি পৌঁছুতে পারে, তা সাহেদ দেখিয়ে দিয়েছে। বাদ দে, আমরা ছাপোষা মানুষ, আমাদের এত ভাবনা কিসের? - তাও ঠিক। এখন দুর্যোগপূর্ণ সময়, নিজেরা কীভাবে টিকবো তা নিয়ে ভাবো। রাখছি রে, আল্পনার রিকোয়েস্ট এলে জানাস। - তুই একটু খোঁজ নে না, ম্যাসেঞ্জারে চোখ রাখ। সবুজ আলো জ্বললে কল দিয়ে দেখ কেমন আছে? - পুরনো স্মৃতি কি মনে পড়ে যাচ্ছে বন্ধু? - নারে, ছত্রিশ বছর তো মনে হয়নি, এখন যখন আবার খোঁজ নেওয়ার সুযোগ হয়েছে, তখন খোঁজ নিতে দোষ কি? - তাও ঠিক। আচ্ছা রাখি। খোঁজ পেলে জানাবোনে। গুড নাইট।

কাশেম সাহেব ফোন রেখে ধীরে ধীরে ড্রয়িং রুমে ঢোকেন। গিন্নী একাগ্রতার সঙ্গে মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখছেন। কাশেম সাহেব টেলিভিশনের স্ক্রিনে চোখ রাখেন। স্টার জলশায় ধারাবাহিক চলছে। আজকাল বাড়ির গিন্নীরা স্টার জলশা, জিটিভি এগুলোতেই বেশি আসক্ত হয়ে পড়েছেন।

তাদের আর দোষ কি? বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো অনুষ্ঠানের চেয়ে বিজ্ঞাপন প্রচারেই বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করলে দর্শকদের আর দোষ কোথায়? কাশেম সাহেব গিন্নীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বেডরুমে রওনা দেন।

 

লেখক: পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।