ক্যাম্পাস

রহিমার বাড়ি ফেরা

আকাশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। মাত্রই বৃষ্টি থেমে গেলো। বর্ষাকাল, একটু পর পর বৃষ্টি রিমঝিম করে গান গায়। এটাই যে বর্ষাকালের ধর্ম। 

বাসা থেকে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুত রহিমা বেগম। তিনি অবশ্য নিজেকে বেগম বলতে অস্বস্তিবোধ করেন। সাধারণত, মেয়েরা বিয়ের পর নিজের নামের সাথে বেগম শব্দটি জুড়ে দেন। কিন্তু রহিমা তার বিয়ে নামক বিষাদের অধ্যায়টি ভুলে থাকতে চান। বাল্যকালে বাবা-মা হারানো রহিমা তার চাচার পরিবারে আশ্রিত হয়ে বেড়ে ওঠেন। অন্যরা পড়ালেখা করলেও রহিমার কপালে তা জোটেনি। চাচার বাসায় গাধার খাটুনি খেটেই বড় হয়েছেন। 

বয়স খানিকটা বাড়তেই পাশের বাড়ির মকবুলের সঙ্গে রহিমার বিয়ে ঠিক করেন চাচি। মকবুল দেখতে শুনতে খারাপ নয়, ঢাকায় নাকি একটা গার্মেন্টসে চাকরি করেন। দুই বছর পর রহিমার ঘর আলোকিত করে জন্ম নেয় রাশেদ। দেখতে ভালো হওয়া মকবুলের চরিত্র ছিল তেল-জলের মতো সম্পূর্ণ বিপরীত। মৃদু হাসির আড়ালে নিষ্ঠুরতার ছাপ কেউ উপলব্ধি করতে পারেনি। নেশাখোর স্বামীর অমানবিক নির্যাতনে বেশি দিন টেকেনি রহিমার সংসার। আগুনের ছ্যাঁকার পিঠের কালো দাগটার কথা চিন্তা করতে এখনো আঁতকে ওঠেন। কিন্তু থেমে যাননি। এখান থেকেই নিজেকে তৈরি করেছেন। 

আকাশ অনেকটাই পরিষ্কার। খুব দ্রুত বৃষ্টি নামবে বলে মনে হচ্ছে না। কাদামাখা পথ ধরেই হাঁটছেন রহিমা। উদ্দেশ্য কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। ট্রেনের টিকেট কাটতে হবে। ঈদুল আজহা প্রায় চলে এসেছে। ট্রেনের অগ্রিম টিকেট ছাড়তেই কমলাপুরে হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমে। দীর্ঘ সিরিয়াল ধরে টিকেট কাটতে হয়। রহিমার ঈদের দিনগুলো প্রায়ই চাচা-চাচির সাথে কাটে। বিশেষ করে কোরবানির ঈদে একটু আগে  যেতে হয়। কোরবানির আগে-পরের সব কাজগুলো রহিমাই করে। বিনিময়ে আসার পথে দু-এক পুটলি মাংস ব্যাগে ভরে দেয় চাচি। রহিমা মুখে ‘লাগবে না’ বললেও অন্তর থেকে তার কষ্টের প্রাপ্তিটুকু ঠিকই চায়।

রেলস্টেশনে গতানুগতিক টিকিট কাটার লম্বা সিরিয়াল। একটু পরখ করেই একটা লাইনের পেছনে দাঁড়িয়ে যায় রহিমা। কখন সে টিকিট পাবে কে জানে! তবে খুব সহজে যে পাওয়া যাবে না, এটা বোঝা যায়। এত সকালে এসেও এত লম্বা লম্বা সিরিয়াল দেখবে এটা অনুমিতই ছিল। রহিমা বাসা থেকে খাবার নিয়ে আসে। দুপুরের খাবার টিকিট কাটার অপেক্ষার লাইনে দাঁড়িয়ে সারতে হবে। রাশুকেও বলে দিয়েছি ক্লাস শেষে যেন এখানে চলে আসে। রাশেদকে আদর করে রাশু ডাকে রহিমা। 

রাশু কলোনির একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। ক্লাস ফাইভে। রোল নং ০৩। হয়তো আরেকটু পরিচর্যা করতে পারলে ক্লাসের প্রথম স্থান অধিকার করতে পারতো। সারাদিন অন্যের বাসায় কাজ করে এসে রহিমা ক্লান্ত শরীরে ছেলেকে সময় দিতে পারে না। কিংবা কিছুটা সময় ছেলের পাশে বসার সুযোগ পেলেও অক্ষরজ্ঞান হীনতার দরুণ ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। রহিমা নিজের ছেলেকে অনেক শিক্ষিত বানাতে চায়। চাচাতো ভাইদের মতো ছেলেকেও স্যুট-টাই পরে অফিসে পাঠানোর স্বপ্ন দেখে।

খানিকক্ষণ আগেই যোহরের আযান হয়েছে। রাশুর স্কুল ছুটি হয়। মায়ের কথামতো সরাসরি কমলাপুর চলে আসে। মাকে খুঁজতে তেমন সময় লাগেনি। নাড়ির বন্ধন যেন চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে দুজনকে। কাউন্টার থেকে ক্রমান্বয়ে টিকিট বিলি হচ্ছে। ইতোমধ্যে রহিমাও কয়েক ধাপ সামনে অগ্রসর হয়েছেন। মা-পুত্রের অবয়বে আনন্দের ঝিলিক। আর কয়েক দিন পর গ্রামের বাড়ি যাবে। খুব কাছ থেকে সবুজ প্রকৃতি উপভোগ করবে। 

নানা বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীটি রাশেদের খুব পছন্দ। ছুটিতে গ্রামের বাড়ি আসলে এখানে নিয়মিত সাঁতার কাটে। পাড়ার ছেলেরা মিলে মাছ ধরে। ধান খেত থেকে নাড়া সংগ্রহ করে। কখনো বা নদীর কোল ঘেঁষা মাঠে ফুটবল খেলে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আবার পাল্লা দিয়ে সাঁতার কেটে নদীটি পাড়ি দেয়। কত দুরন্তপনার চিত্র লেপ্টে আছে নানা বাড়ির ছোট্ট নদীটিকে ঘিরে।

সামনের মানুষগুলো যেন এগোচ্ছেই না। ‘একটা টিকেট কাটতে এতক্ষণ লাগে!’ রহিমার চোখে-মুখে প্রবল বিরক্তির ঢেউ খেলছে। ক্ষমতাবান লোকগুলো সিরিয়াল ছাড়া টিকেট কাটে। রহিমার খুব রাগ হয় প্রশাসনের উপর। রাশেদ পাশে দাঁড়িয়ে গুনগুন করছে। হয়তো খিদে লেগেছে। ব্যাগ খুলে খাবার বের করে রহিমা। পালংশাক আর ডিমের সালুন (তরকারি)। রহিমা ছেলেকে খাইয়ে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে নিজেও খাচ্ছে। ‘দাঁড়া আর কয়েক দিন পরই তো আমরা বাড়ি যামু, তোরে শুধু গোশত দিয়ে ভাত খাওয়ামু।’ মায়ের কথায় হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে রাশেদ। 

রহিমার অক্ষিযুগল ছলছল করছে। বিধাতা তাকে অতিরিক্ত ভালো একটি ছেলে দিয়েছেন। যে কোনো কিছুর জন্য বায়না ধরে না। চাহিদাসূচক কোনো দাবি উত্থাপন করে না মায়ের কাছে। রহিমার অনেক ইচ্ছে হয় ছেলেকে অনেক কিছু কিনে দিতে। রাজপুত্রের মতো ছেলেকে সাজিয়ে রাখতে। কিন্তু অন্যের বাড়িতে কাজ করে মাস শেষে স্বল্প আয়ের অর্থ সংকটে দিনাতিপাত করে স্বপ্নগুলো অধরাই থেকে যায়।

মা-ছেলের খাওয়া শেষ হয়। রাশু বাসায় যায়। ব্যাগ পত্র রেখে গোসল সেরে আবার মায়ের কাছে চলে আসে। মাঝে কালোবাজারের টিকিট পসারি রহিমার কানের কাছে গুনগুন করছিল। রহিমা পাত্তা দেয়নি। যতই দেরি হোক, লাইনে সারিবদ্ধ থেকে টিকিট নিবে। অসৎ পথেই নাকি নিহিত বিকৃত মস্তিষ্কের নিকৃষ্ট ভাবনা। গত ঈদ থেকে যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। কালোবাজারের পাল্লায় পড়ে টাকা, টিকিট দুটিই হারিয়েছে রহিমা। অর্থাভাবে দ্বিতীয়বার টিকিট কিনে বাড়ি যাওয়া সম্ভব হয়নি।

সূর্য্যি মামা হেলতে-দুলতে ইতোমধ্যে আপন কক্ষপথে ঘুমিয়ে পড়েছে। আঁধারের অভিশাপ মুছতে চতুর্দিকে কৃত্রিম আলো জ্বলছে। সামনের মানুষগুলো টিকিট হাতে বাসার পথ ধরেছেন। পেছনেও যেন মন্থর গতির পিপীলিকার সারিবদ্ধ চলাচল। খানিকক্ষণ পর এক কদম করে সামনে এগুচ্ছে ধৈর্যশীল মানুষগুলো। রহিমা একেবারে কাউন্টারের সামনে চলে এসেছে। কয়টা লাগবে টিকিট, স্যার দুইটা। রহিমা টাকা দিয়ে টিকিটগুলো হাতে নেয়। উচ্ছ্বাসে বুক ভরে যায়। 

প্রায় দীর্ঘ এক বছর পর বাড়ি যাবে। গ্রামে খুব কাছের আপনজন না থাকলেও জন্মস্থানের মৃত্তিকার গন্ধ রহিমার ভালো থাকার উপাদান। মা-ছেলে দুজন হাত ধরে বাসায় ফিরে। রাশেদ দারুণ খুশি। নানা বাড়ি গিয়ে কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবে তার বর্ণনা দেয়। আর কয়েক দিন পর গ্রামের বাড়ি যাবে। রহিমা এখনই ব্যাগ গোছানো শুরু করে দেয়। বাধভাঙ্গা আনন্দে প্লাবিত হয় তৃষ্ণার্ত মন। লম্বা সময় পরে বাড়ি যাবে। আর যাই হোক, ছেলেকে গোশত খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি কিছুটা হলেও রক্ষা করতে পারবে।

 

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।