ক্যাম্পাস

কয়েক ফোঁটা রক্তের জন্য অপেক্ষা… 

২৪ জুলাই সন্ধ্যায় হঠাৎ সালমানের ফোন- তুই কোথায়? ফোনে কণ্ঠস্বর শুনে বুঝেছি নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে! জবাব দিলাম- সাইকেল নিয়ে বিলোনিয়া এসেছি। করোনায় সারাক্ষণ ঘরবন্দি থেকে মন বিষ হয়ে আছে। তাই প্রশান্তি খুঁজতে বিকেলে সাইকেল নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম। মুন্সিরহাট দিয়ে যেতে একেবারেই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কাছে চলে এসেছি।

আমি বিলোনিয়া চলে এসেছি শুনেই তার গলা আরও ছোট হয়ে যায়। এত দূর সাইকেল নিয়ে! সে তাৎক্ষণিক বলে উঠলো- হাবিবের চাচাতো বোনের জন্য ইমার্জেন্সি এক ব্যাগ বি-পজেটিভ রক্ত লাগবে চট্টগ্রাম মেডিক্যালে। তোর তো বি-পজেটিভ। তাড়াতাড়ি আয়। আমি এ কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। কী করবো, কী উত্তর দেব কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। সালমান বললো, সাইকেলটা বাসের ছাদে তুলে দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি চলে আয়।

বিলোনিয়া থেকে দ্রুত গতিতে সাইকেল চালিয়ে পরশুরাম বাজার পর্যন্ত এসে সাইকেলটা তুলে দিলাম বাসের ছাদে। তাড়াহুড়ো করে বাড়িতে আসলাম। বাড়িতে ঢুকতেই দেখি সালমান আর হাবিব আমার জন্য গাড়ি দাঁড় করিয়ে অপেক্ষা করছে। উঠে যাই গাড়িতে। মুন্সিরহাট থেকে চট্টগ্রাম মেডিক্যালের পথে রওনা দিয়েছি। মুঠোফোনে বারবার কল আসছে- কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে হতাশ কণ্ঠে ভেসে আসছে- আর কতক্ষণ লাগবে? চট্টগ্রাম মেডিক্যালের মা ও শিশু ওয়ার্ডে ২০ দিন বয়সের শিশুটা জীবনের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। কয়েক ফোঁটা রক্তের জন্য অপেক্ষা।

পৃথিবীর আলো দেখার দিন থেকেই ওর শরীরে দেখা দেয় রক্তস্বল্পতা। তার রক্তে শ্বেত কণিকার ঘাটতি দেখা দেয়। ডাক্তাররা সময় বেঁধে দিয়েছেন। নির্দিষ্ট সময়ে রক্ত দিতে না পারলে বিপদ।

নির্ধারিত সময়ের কিছুক্ষণ আগে গিয়ে চমেকে পৌঁছলাম। আমাদের তিনজনের মধ্যে সালমান আর আমার রক্তের গ্রুপ বি পজেটিভ। একজনের রক্ত দিতে কোনো সমস্যা হলে বিকল্প হিসেবে আরেকজন থাকবে। আমি দিতে চাইলাম। কিন্তু সালমানের কাছে হার মানলাম। সালমান স্যাম্পল দিলো। ব্লাড দিলো। ঘণ্টাখানেক পর শুনতে পেলাম শিশুটা এখন ভালো আছে। খবরটা শুনে আমাদের তিন বন্ধুর সব অবসাদ, বিষন্নতা নিমিষেই দূর হলে গেলো। আমাদের ক্ষুদ্র ত্যাগে একটা শিশুর জীবন প্রদীপ নিভে যেতে যেতে আবার আলোয় ফিরে পেলো। এটা ভেবে নিজেদের ভেতরে একটা অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে। যে ভালো লাগা শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করার মতো নয়।

মানবসেবায় এক ধরনের আত্মতৃপ্তি আছে। এর মধ্য দিয়ে স্রষ্টা ও সৃষ্টি উভয়ের হক আদায় করা যায়। মানুষ সামাজিক জীব। সে হিসেবে মানুষের একে-অপরের প্রতি রয়েছে কিছু সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা। আর এর মধ্যে স্বেচ্ছায় রক্তদান অন্যতম। রক্তদান একটি মহৎ মানবিক কাজ। আপনার রক্তের মাধ্যমে আরেকজন মানুষের প্রাণ বেঁচে যাবে এর মতো মহৎ মানবিক কাজ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টা হতে পারে না। রক্তদান সামাজিক প্রীতিবন্ধন মজবুত করে। সামাজিক দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি করে। এমনকি ধর্মীয় সম্প্রীতি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

মানুষের রক্তের প্রয়োজনে মানুষকেই রক্ত দিতে হয়। জীবন বাঁচানোর জন্য রক্তদান এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, বলা হয়- ‘করিলে রক্তদান, বাঁচিবে একটি প্রাণ’, ‘আপনার রক্ত দিন, একটি জীবন বাঁচান’, ‘সময় তুমি হার মেনেছ রক্তদানের কাছে, দশটি মিনিট করলে খরচ একটি জীবন বাঁচে।’

দেখা যায় রক্তদানে অনেকেই ভয় পান। কেউ কেউ ভাবেন এতে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। দুর্বল হয়ে পড়বেন বা রোগাক্রান্ত হয়ে পড়বেন রক্তদাতা। কেউ আবার মনে করেন এতে হৃৎপিন্ড দুর্বল হয়ে যাবে বা রক্তচাপ কমে যাবে। এমনকি কার্যক্ষমতা কমে যাবার আশঙ্কাও করেন অনেকে। ফলে কিছু কুসংস্কার আর অজ্ঞতা অনেক সময় মানুষকে রক্তদানে নিরুৎসাহিত করে।

যে কোনো সুস্থ-সবল মানুষ রক্তদান করলে তার স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি হয় না। এমনিতেই আমাদের রক্তের লোহিত রক্ত কণিকাগুলো স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ৪ মাস পরপর নষ্ট হয়ে যায়। সুতরাং নষ্ট করার চেয়ে তা স্বেচ্ছায় অন্যের জীবন বাঁচাতে দান করাই উত্তম। সামান্য পরিমাণ রক্তদানের মাধ্যমে একটি জীবন বাঁচানো নিঃসন্দেহে মহৎ কাজ।

 

লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

চবি/মাহফুজ/মাহি