ক্যাম্পাস

অণুগল্প: যোগসূত্র

ঈদের আগে থেকেই কাশেম সাহেবের মন খারাপ। প্রতিবছর ভাইয়ের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে তিনি কোরবানি দেন। গ্রামের গরীব আত্মীয় স্বজনের মধ্যে কোরবানির মাংস নিজ হাতে বিতরণ করেন। তাদের ভালো-মন্দ খবর নেন। বয়স্ক স্বজনদের বাড়িতে গিয়ে গিয়ে খোঁজ নেওয়াটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। এবারে তার কোনোটিই করতে পারেননি।

সকালে ঘুম থেকে জেগে কাশেম সাহেব মনমরা হয়ে ড্রয়িং রুমে বসে বসে দৈনিক পত্রিকার পাতা ওল্টাচ্ছিলেন, ল্যান্ড ফোন বেজে ওঠে। কশেম সাহেব অনিচ্ছা সত্বেও ফোনটা ধরলেন - হ্যালো - রাজিব বলছি - রাজিব? ঠিক চিনতে পারছি না? কোথা থেকে বলছেন? - রাজিব চৌধুরী। ভুলে গেছো? আমি তোমাদের ডিপার্টমেন্টের, তোমার আগের ব্যাচের, একই হলে থাকতাম। কি তাও চিনতে পারছো না? - হ্যাঁ, হ্যাঁ চিনতে পেরেছি। আপনি ভালো গাইতেন, ফুটবলও খেলতেন। রাজিব দা, পশ্চিম ব্লকের রাজিব দা। তা এতোদিন পরে? আমার নম্বরই বা পেলেন কোত্থেকে? - ডিপার্টমেন্টের স্মরণিকা থেকে। কেমন আছো তুমি? - জ্বি আছি মোটামুটি। আপনি, আপনারা? - আমি তো ভালোই আছি। কিন্তু তুমি কেমন আছো? তোমার সেই বন্ধুটা, ওই যে কি যেনো নাম, নাটক করতো? - আপনি বোধহয় হাসানের কথা বলছেন? - হ্যাঁ, হ্যাঁ হাসান, হাসানই তো। তোমরা দু’জনে খুবই ক্লোজ ছিলে। - জ্বি দাদা, হাসান রাজশাহীতেই থাকে। ওখানেই সেটেলড সে। আপনার সঙ্গে অনেকদিন পরে কথা হচ্ছে। ক্যাম্পাস ছাড়ার পরে তো আর দেখাই হয়নি। - তা ঠিক। স্মরণিকাতে তোমার ছবিটা দেখেই তো চিনে ফেললাম। তুমি সেই আগের মতোই আছো। শোনো, আমি কিন্তু একটা উদ্দেশ্যে নিয়েই তোমাকে ফোন করেছি। অনেকদিন দেশে ছিলাম না। তা ধরো প্রায় ত্রিশ বছর জার্মানিতে। আমার আত্মীয় স্বজন বেশিরভাগই পাশের দেশে সেটেলড হয়েছে। আমি তা চাই না। জার্মানিতে অনেক ভালো আছি, তোমার বৌদি, আমাদের সন্তানেরা সেখানে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। - জ্বি। সেটাই তো স্বাভাবিক। - হ্যাঁ। যা বলছিলাম, আমি করোনা দূর্যোগের কয়েকদিন আগে দেশে এসে আটকে আছি। গ্রামেই আছি। আমাদের গ্রামটা উপজেলা সদর থেকে মাইল দশেক ভেতরে। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই ভালো৷ এখানে আমাদের কয়েক একর জমির ওপর বাড়ি, এলাকার জন্যে কিছু একটা করার ইচ্ছে আছে। একটা উন্নতমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তুমি তো অবসর জীবন কাটাচ্ছো, ঢাকা থেকে দু’তিন ঘণ্টার পথ। আসতে পারবে? তোমার সঙ্গে সামনা সামনি বসে আলোচনা করা যেতো। সকালে এসে বিকেলে ফিরতে পারবে। বললে আমার গাড়িটা পাঠিয়ে দিতে পারি। - দাদা, আমার কিছু জরুরি কাজ এখনো শেষ হয়নি, কয়েকদিন লাগবে। - তুমি বললে আমিও আসতে পারি। তবে জায়গাটা দেখলে প্ল্যানিংয়ে সুবিধা হবে। - আচ্ছা দাদা, আপনার মোবাইল নম্বরটা দিন, আমি কাল আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করি? - শোনো, কোনো ইতঃস্তত করো না। না পারলে সরাসরি না বলবে। মাইন্ড করবো না। তোমাকে ক্যাম্পাসে দেখেছি। এখানে এসে বন্ধুদের কাছ থেকে তোমার সম্পর্কে শুনেছি। প্রায় সবাই তোমাকেই  অ্যাপ্রোপিয়েট বলেছে। তাই তোমাকে ফোন দিলাম। - না না দাদা, তা নয়, আচ্ছা আমি রাতেই আপনাকে ফোন দেবো কেমন? কাশেম সাহেব রাজিব দা’র ফোন নম্বর লিখে নেন। গ্রামের লোকেশনটা জেনে নিয়ে আরো কিছু কথাবার্তা বলে ফোনটা রেখে দিতে গিয়ে দেখেন গিন্নী পাশে দাঁড়িয়ে। তার চোখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন। - কে ফোন দিয়েছিলো? - ক্যাম্পাসের বড়ভাই। কাশেম সাহেব গিন্নীকে রাজিব দা’র সঙ্গে ফোনে যে কথপোকথন হয়েছে তা জানান। গিন্নী জানেন, কর্তার যা মনে আছে তাই করবেন। কোনো কিছু বলে লাভ নেই। তাই কোনো মন্তব্য না করে রান্না ঘরে ঢোকেন। কাশেম সাহেব রাজিব চৌধুরীর চেহারাটা মনে করতে চেষ্টা করেন। হালকা পাতলা চেহারা। হলের হয়ে ফুটবল খেলতেন। লেফট উইং দিয়ে দ্রুত বল নিয়ে প্রতিপক্ষের গোলের কাছাকাছি গিয়ে স্ট্রাইকারের কাছে বল ফেলতে পারতেন। রাজিব দা গানও ভালো গাইতেন। হল এবং ক্যাম্পাসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মান্না দে'র গানই বেশি গাইতেন। কাশেম সাহেব ভেবে পান না। এতো মানুষ থাকতে রাজিব চৌধুরী তাকে কেন বেছে নিলেন। শুধু কি অবসর। না অন্য কোনো কারণ? বিষয়টি নিয়ে হাসানের সঙ্গে কথা বলবো নাকি? না থাক। বিকেলে আনোয়ার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে তার মতামতটা নিতে হবে। কাশেম সাহেব খেয়াল করেন কোথাও মোবাইল ফোনটা বাজছে। বেডরুমের দিকে এগিয়ে যেতেই গিন্নী ফোনটা এনে হাতে দেন। অনেকগুলো মিস কল। আবার কল হয়। কাশেম সাহেব ডাইনিং টেবিলে বসে ফোনটা ধরেন। শেওড়াপাড়া থেকে ছোট শ্যালকের ফোন। - দুলাভাই, ভেসে গেছি। - মানে কি? - পানিতে ছয়লাব। একঘণ্টার বৃষ্টিতে আমাদের ভাসিয়ে দিয়েছে। একটা নৌকা পাঠান। - মেয়র সাহেবকে ফোন দাও। তোমাদের পারাপারের ব্যবস্থা নেবেন। - ইয়ার্কি নয়, সত্যি সত্যিই রাস্তা, গলি সব ডুবে গেছে। বাসায় ফিরেছি মাজাপানি ঠেলে। বাসায় এসে দেখি ইলেক্ট্রিসিটিও নেই, যাচ্ছেতাই অবস্থা। - রাজধানী ছেড়ে মফস্বলে পোস্টিং নাও। তাও তো যাবে না? আমার মতো জেলায় জেলায় চাকুরি করে এসো। ভালো থাকবে। - বুঝেছি, জ্ঞান বিতরণ করার অভ্যাস এখনো যায় নি। রাখি তাহলে? - ফোন দিয়েছিলে কেন? - দুরবস্থার কথা জানাতে। - আপার সঙ্গে কথা বলবে না? - কথা হয়েছে। রাখলাম। শ্যালক লাইনটা কেটে দেয়। কাশেম সাহেব ফোনটা হাতে নিয়েই বেডরুমে ঢোকেন। গিন্নী ঘুরে তাকান। - নাঈমা ফোন করেছিলো - কেন? - তোমার এজি অফিসের কাজ রেডি হয়ে গেছে, তোমাকে গিয়ে কয়েকটা সই দিতে হবে, তারপর ব্যাংকে পাঠিয়ে দেবে। কালই যেতে বলেছে। - আর কিছু বলেনি? - আর আবার কি বলবে? - তোমার বান্ধবী বলে খাতির করবে নাকি? - কিসের খাতির? - সে তুমি বুঝবে না। খালি পকেটে যাবো না পকেট ভর্তি করে যাবো তা যখন বলেনি, গিয়েই দেখি কি বলে? - তাই আবার হয় নাকি? নাঈমার সাথে আমার কতদিনের সম্পর্ক - যাক, না লাগলে তো ভালোই। আলম ফোন দিয়েছিলো? - হ্যাঁ, কথা হয়েছে। তোমাকেও ফোন দেবে বলছিলো, দিয়েছে? - হ্যাঁ কথা হলো। কাশেম সাহেব বিছানায় শরীর এলিয়ে দেন। মাথার মধ্যে রাজিব দা’র প্রস্তাবটা খেলা করে। তার নিজের খুব ইচ্ছে ছিলো একটা উন্নতমানের আবাসিক স্কুল প্রতিষ্ঠার। সাধ্য ও সখের বিস্তর ফারাকের কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কাশেম সাহেব ভাবতে থাকেন এখন কি তিনি রাজিব চৌধুরীর প্রস্তাবে সাড়া দেবেন, নাকি না করবেন! কাশেম সাহেব বিছানা থেকে উঠে আবার ড্রয়িং রুমে ঢোকেন। ল্যান্ড ফোনে হাসানকে কল করে বিস্তারিত খুলে বলেন। হাসান বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে।- শোন, রাজিব দাকে আমি চিনি। জার্মানিতে আমার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিলো। তিনি ওখানে প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং এখানে এসে তার ব্যবসায়িক দৃষ্টভঙ্গির চেয়ে সেবামূলক মানসিকতাই থাকার কথা। তুই পজিটিভলি ভেবে দেখতে পারিস। তাছাড়া - তাছাড়া কি? - তুই বোধহয় জানিস নে, আল্পনা রাজিব দা’র বন্ধুর বউ। - বলিস কি? তাই নাকি? তুই কবে জানলি? - সে দিনই কথা প্রসঙ্গে আল্পনা বলছিলো। আল্পনার স্বামীতো রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেই পড়ছে। রাজিব দা’র কলেজ বন্ধু। ক্যাম্পাসে থাকতে অবশ্য যোগাযোগ হয়নি। সেটেল ম্যারেজ। সম্ভবতঃ রাজিব দা-ই ব্যবস্থা করেছেন। - বাহ! - বাহ! মানে? - বাহ! মানে বাহ! বুঝতে পারছি। কোনো যোগসূত্রও থাকতে পারে। দেখি কি করা যায়। আচ্ছা রাখি, ডাক পড়েছে।

কাশেম সাহেব ফোন রাখে বেডরুমে গিয়ে ঢোকেন। গিন্নী পাশ ফিরে কাশেম সাহেবকে দেখে সরে গিয়ে জায়গা করে দেন। কাশেম সাহেব বিছানায় শুয়ে ভাবতে থাকেন। তার ভাবনায় কি আল্পনা, না নতুন স্কুল গড়ার স্বপ্ন কে জানে!

লেখক: পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।

গবি/মাহফুজ/মাহি