ক্যাম্পাস

‘নারীরা স্বভাবতই একেকজন শিক্ষক’ 

‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’

নজরুলের ভাষায় বিশ্বের যা কিছু কল্যাণকর, মঙ্গলজনক ও শুভ তার সবকিছুতেই পুরুষের পাশাপাশি নারীর সম অবদান। দুই অক্ষরের শব্দ নারী। অথচ এই শব্দটির সাথে জড়িয়ে আছে কত মমতা, কত আবেগ, কত প্রেরণা, কত অর্জন। একজন স্বশিক্ষিত নারীই হতে পারেন একজন সফল মা, একজন সফল শিক্ষক। 

এমনই একজন সফল শিক্ষকের দৃষ্টান্ত হলেন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক আফরোজা সিদ্দিকা। শিক্ষকতা পেশায় আসার পেছনের গল্প জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি জাতির সভ্যতার প্রধান মাপকাঠি হলো শিক্ষা। আর শিক্ষার্থীদের জীবনে এ বিরাট পরিবর্তন আনার জন্য শিক্ষকতা হলো একটি অঙ্গীকার। একমাত্র শিক্ষকতার মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল ও ভালো কাজের জন্য উদ্দীপ্ত করা সম্ভব। আমার মাও একজন শিক্ষক ছিলেন। মায়ের অনুপ্রেরণাই আজ আমাকে এ অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে। 

তিনি আরও বলেন, একজন শিক্ষক যদি শিক্ষার গুরুত্ব পুরোপুরি না বোঝেন এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি মনোযোগী না হন, তাহলে সেই শিক্ষকের পক্ষে কখনো একজন ভালো, সফল, প্রেরণাদায়ক ও পরিতৃপ্ত শিক্ষক হওয়া সম্ভব নয়।

ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট বলেছিলেন, ‘আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।’ তাহলে একজন শিক্ষিত নারী যে একটি শিক্ষিত রাষ্ট্র উপহার দিতে পারেন এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। 

একজন আদর্শ শিক্ষকই একটি জাতির মেধা গড়ার কারিগর। এমনই একজন আদর্শ শিক্ষক গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের লেকচারার ফারজানা তাসনিম রেখা। নারীরা কেন শিক্ষকতা পেশাকে এতটা আগ্রহের সাথে দেখেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যেমন মেরুদণ্ড প্রয়োজন, তেমনি একটি জাতির মেরুদণ্ডকে দাঁড় করাতে প্রয়োজন শিক্ষা। একজন সুশিক্ষিত নারীই উপহার দিতে পারেন একটি সুন্দর সমাজ। কর্মজীবনে পুরুষের পাশাপাশি নারীর স্থান নিশ্চিত হলে সর্বক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

যদিও শিক্ষকতা পেশায় বিত্ত বৈভব বা প্রাচুর্য নেই, নেই কোনো সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় প্রতিপত্তি। তবে এই পেশায় রয়েছে সুন্দর পরিবেশ এবং সম্মান। মূলত এই কারণেই নারীদের কাছে পছন্দের পেশা হিসেবে শিক্ষকতা জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, বলেন তিনি। 

নারীরা বর্তমানে জীবনের সর্বক্ষেত্রে অবদান রাখছে এবং সুশিক্ষিত হয়ে উপার্জনে অংশ নিচ্ছে। তাদের পদচারণায় মুখরিত হচ্ছে সমাজের প্রতিটি স্তর। তারা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আর্কিটেক্ট, ব্যাংকার, পুলিশসহ সব স্বনামধন্য পেশাতে যুক্ত হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় শিক্ষকতা পেশায় এগিয়ে নারীরাও। তবে এই পেশায় আত্মতৃপ্তি কতটুকু, এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলা সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক ড. কৃষ্ণা ভদ্র বলেন, ছাত্র-ছাত্রীরা আমার প্রাণের অনুভূতি। তাদেরকে ঘিরে আমার প্রতিদিনের দিনপঞ্জি। শিক্ষার্থীদের প্রাণবন্ততা, সাবলীল আচরণের প্রভাব আমার অধ্যাপনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

আর যখনই শিক্ষার্থীদের মাঝে এই দিকগুলো পরিলক্ষিত হয়, আমি আত্মতৃপ্তিতে আপ্লুত হই। এই আত্মতৃপ্তির কারণেই জগতের যেকোনো পেশার চেয়ে শিক্ষকতাকে আমি অত্যন্ত পরিতৃপ্তির পেশা বলে মনে করি।

শিক্ষার্থীদের একাডেমিক শিক্ষাদানের পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা শিক্ষার মাধ্যমে দেশের সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলাই একজন শিক্ষকের নৈতিক দায়িত্ব। এমনই এক দায়িত্বশীল প্রশংসনীয় শিক্ষকের দাবিদার হলেন গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিবোধ ও সমতা বিভাগের শিক্ষক কাজী মাহফুজা হক। 

নারীদের শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হওয়াটা আপনি কতটা যুক্তিযুক্ত মনে করেন, এমন প্রশ্নের বিশ্লেষণে তিনি বলেন, সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট প্রত্যেক নারীই স্বভাবত একেকজন শিক্ষক। কেননা মানুষের শিক্ষাকার্যক্রম শুরু হয় মায়ের হাতে। আধুনিক শিক্ষা শিশু কেন্দ্রিক অর্থাৎ শিশুকে মুখ্য হিসেবে বিবেচনা করে তার চাহিদা, আগ্রহ, সক্ষমতা ইত্যাদির প্রাধান্য দেওয়া হয়।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রকৃতির শিক্ষাকে অধিক মূল্য দিয়েছেন। সেদিক থেকে নারী হচ্ছে প্রকৃতির আদর্শ উপাদান। যার রয়েছে অসীম ধৈর্য্য এবং মমতা। যিনি শিক্ষার্থীকে যান্ত্রিক শিক্ষার পরিবর্তে সামাজিক ও মানবিক শিক্ষা প্রদান করে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলেন। 

একজন নারী শিক্ষক অর্থাৎ একজন শিক্ষিত নারীর মতামত পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, জাতি যেভাবে মূল্যায়ন করে একজন সাধারণ নারীর মতামত সেভাবে কখনোই মূল্যায়িত হয় না। আর শিক্ষকতা নারীদের জন্য এমন একটি পেশা, যেখানে সে পরিবার সামলিয়ে তার পেশাকে সাদরে গ্রহণ করতে পারেন। এক্ষেত্রে পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নিতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন অধিকাংশ স্বশিক্ষিত নারী।

শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে পরিবর্তনশীলতা। আর নারীরা এই পেশায় এগিয়ে এলে মানুষে মানুষে যে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে, তা পরিবর্তিত হয়ে এক মানবিক বিশ্ব গড়ে উঠবে এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়। 

গবি/মাহি