স্মার্টফোন ব্যবহার করেন আর টিকটকের ভিডিও দেখেননি এমন কাউকে পাওয়া কঠিন। কিংবা বহুল ব্যবহৃত কলিং অ্যাপ ইমো ব্যবহার করেন অথচ এটি থেকে বিচিত্র রকমের প্রেম নিবেদনকারী নোটিফিকেশন পাননি এমন মানুষও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
সিনেমা-নাটকের জনপ্রিয় সংলাপ, গান বা ওয়াজ মাহফিলের বক্তাদের বক্তব্যের একাংশের সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়ে ও হাত-পা নাড়িয়ে ভিডিও তৈরির অ্যাপস টিকটক ও লাইকির ব্যবহার দিন দিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এসব অ্যাপসের মাধ্যমে যেসব অশ্লীল ভঙ্গিমায় দেহ প্রদর্শন, ব্যঙ্গাত্মক ভিডিও নির্মাণ ও বিকৃত মানসিকতার প্রচার ও প্রসারের মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা যেকোনো রুচিশীল ও বিবেকসম্পন্ন মানুষের কাছে সহজেই বোধগম্য। তারকা থেকে শুরু করে উঠতি বয়সের কিশোর-কিশোরী কেউই পিছিয়ে নেই এক্ষেত্রে। বয়স্ক মানুষের আগ্রহও বেশ চমকে ওঠার মতো।
সম্প্রতি চীনের বাইটডান্স নির্মিত ‘টিকটক’ ও সিঙ্গাপুরভিত্তিক সংস্থা বিগোর ‘লাইকি’ অল্প সময়ে বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে এশিয়ায় কিশোর-কিশোরীদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ২০১৭ সাল নাগাদ টিকটক এবং লাইকি বিশ্ব বাজারে উন্মুক্ত হওয়ার পর থেকেই হু হু করে বাড়তে থাকে এ দুটির ব্যবহারকারীর সংখ্যা। বর্তমানে টিকটক এবং লাইকি এশিয়ায় নেতৃত্বস্থানীয় দুটি ছোট ভিডিও প্ল্যাটফর্ম এবং সব থেকে বড় সংগীত ভিডিওভিত্তিক দ্রুততম ক্রমবর্ধমান সামাজিক নেটওয়ার্ক ও প্ল্যাটফর্ম।
গ্লোবাল ওয়েব ইন্ডেক্স- এর তথ্যমতে, বর্তমানে টিকটক ও লাইকি ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। ব্যবহারকারীর সংখ্যায় শীর্ষে থাকা ভারতে চলতি বছরের ৩ এপ্রিল দেশটির আদালত কর্তৃক টিকটক নিষিদ্ধ করার জন্য কেন্দ্রকে নির্দেশ দেওয়ার পর বাংলাদেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ঝড় ওঠে। এই অ্যাপ বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছেন তারা। যদিও এখন অব্দি মাধ্যম দুটি নিয়ন্ত্রণের আশানুরূপ কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি।
গত ৩ আগস্ট সাধারণ মানুষকে হেনস্থার অভিযোগে কথিত টিকটক স্টার অপুকে সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় ফের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ঝড় ওঠে। টিকটক-লাইকির নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহার ও ব্যবহারকারীদের রুচি বিবর্জিত তথাকথিত ট্রেন্ড নিয়ে হয় আলোচনা-সমালোচনা।
নিছক বিনোদন ও অল্প সময়ে ভাইরাল হওয়ার প্রবণতা থেকে এসব সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের জনপ্রিয়তা বাড়তে দেখা গেলেও ইদানীং অল্প কিছু পয়সা আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় কিশোর-কিশোরীদের আগ্রহে নতুনমাত্রা যোগ হয়েছে। সুবিধা এবং শিক্ষাবঞ্চিত নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে ওঠে আসা কিশোর-কিশোরীরা চোখের সামনে সামান্য কিছু অর্থের লোভ আর সস্তা জনপ্রিয়তার হাতছানি দেখে সেগুলোতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নির্দ্বিধায়। বিচিত্র প্রাণীদের মতো হেয়ারস্টাইল আর কিম্ভূতকিমাকার বেশভূষা ধারণ করে ভিডিও ধারণের পর তা শুধু মাধ্যম দুটোয় আপলোড দিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না তারা। সেগুলোকে বাস্তব জীবনের অনুষঙ্গ বানিয়ে হাজারো তরুণ তথাকথিত হিরো বা মডেল বনে গিয়ে ফিল্মি কায়দা-কসরত দেখানোর নামে তৈরি করছে কিশোর গ্যাং।
সেখান থেকে শুরু দাদাগিরি। আজব নাচ আর বিদেশি ভাষার গান ছাড়াও যে প্রতিভা প্রদর্শনের সুস্থ-স্বাভাবিক-সৃজনশীল পন্থা আছে তা যেন এই মাধ্যমগুলোর ব্যবহারকারীদের জানা নেই। মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি পারিবারিক শিক্ষার অভাব, দারিদ্রতা ও বিদেশি অপসংস্কৃতির ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে দিয়ে সামাজিক মূল্যবোধ হারিয়ে মূল্যহীন জনপ্রিয়তার দিকে ছুটছে এসব তরুণ-তরুণীরা।
অবশ্য রুচি বিবর্জিত এসব ভিডিও দেখে এ সুযোগ সৃষ্টিতে তাদেরকে পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি আমরাই। ভাইরাল হওয়ার ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত দেশব্যাপী তরুণ সমাজের বিরাট একটা অংশ। ফলে নৈতিকতা, সামাজিকতা, শ্লীলতা কিংবা মানবিক মূল্যবোধের মতো অত্যাবশ্যকীয় সামাজিক গুণাবলীর সংকটে পড়া তরুণ প্রজন্মের এই বিশাল অঙ্কটা পুরো জাতির মানসিক পরিপক্কতার বিপরীতে ক্রমবর্ধমান ক্যান্সার হিসেবেই আবির্ভূত হতে যাচ্ছে । সেই সঙ্গে এখান থেকে গজিয়ে ওঠা কিশোর গ্যাং আগামীর বাংলাদেশে জনশৃঙ্খলার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে ওঠাকে ক্রমশই ত্বরান্বিত করছে। এখনই নাগাল টানতে হবে। প্রযুক্তি নির্ভর একুশ শতকের তরুণ প্রজন্মকে সুপথে রাখা না গেলে হয়তো সোনার বাংলার আকাশ অদূর ভবিষ্যতে কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যাবে। সেই ধোঁয়ার বিষাক্ত থাবায় বাঁচতে পারবো না আমরা কেউই।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
রাবি/মাহফুজ/মাহি