ক্যাম্পাস

‘গণতান্ত্রিক সরকারের মূল শক্তি জনগণ’  

‘গণতন্ত্র’ আমাদের সমাজে অতিপরিচিত একটি শব্দ। শব্দটি আমাদের খুবই প্রিয়, কারণ এই শব্দের মাঝে আমরা আমাদের স্বাধীনতা খুঁজে পাই এবং মত প্রকাশের অধিকারও। কিন্তু এগুলো কতটুকু সত্য আর বাস্তবতা? বাস্তবে কি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত, নাকি এটি আমাদের জন্য শুধু ব্যবহৃত শব্দ? 

গণতন্ত্রের ( Democracy ) উৎপত্তি : প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ক্লিসথেনিসের নতুন ধরনের সরকার চালু হয় এবং সেই সঙ্গে বিশ্বের প্রথম গণতন্ত্র সৃষ্টি হয় গ্রিসের ছোট একটি শহর-রাষ্ট্র এথেন্সে। এরপর ১২১৫ সালে ইংল্যান্ডের রাজা জন এই চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হন। যার নাম ম্যাগনাকার্টা (Magacarta),  এই চুক্তির উপর ভিত্তি করেই পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূত্রপাত ও আইনের শাসনের ভিত্তি রচিত হয়। বলা হয়ে থাকে, এটি শাসনতন্ত্রের বাইবেল এবং ইংল্যান্ডের প্রথম শাসনতন্ত্র। 

তবে আধুনিক গণতন্ত্রের জনক বলা হয় জন লক ( jhon locke ) কে। তিনিই প্রথম সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা বলেছেন। যেখানে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবে এবং জনপ্রতিনিধিরা সরকার পরিচালনা করবে। এর পূর্বে পৃথিবীতে সরকার ব্যবস্থা ছিল রাজতন্ত্র। সেখানে জনগণের মতামতের কোনো মূল্য ছিল না। কিন্তু গণতন্ত্রে জনগণের মতামতের মূল্যায়ন সব চেয়ে বেশি হয় এবং এই জন্য গণতন্ত্র নিয়ে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দিয়েছেন সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকন, তা হলো- Democracy is a government of the people, by the people and for the people, অর্থাৎ গণতন্ত্র হলো জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের শাসন।  

কোন দেশে গণতন্ত্র আছে, তা বোঝা যাবে ঐ দেশের সংবিধান ও সরকার ব্যবস্থা দেখে। সংবিধান একটি রাষ্ট্র চালানোর মূল নিয়মকানুন, আর সেই সংবিধান ও এর অনুগত আইন অনুযায়ী ঐ রাষ্ট্রের সরকারব্যবস্থা চালিত হয়। পৃথিবীতে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা দুই ধরনের আছে রাষ্ট্রপতি শাসিত (USA ) আর একটি মন্ত্রীপরিষদ শাসিত (ব্রিটেন)। তবে উভয় সরকারই জনপ্রতিনিধি পরিষদের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। আর এই জনপ্রতিনিধি পরিষদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই কক্ষবিশিষ্ট একটি কংগ্রেস আর অন্যটি সিনেট। তবে আমাদের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের এক কক্ষবিশিষ্ট, যার নাম জাতীয় সংসদ, যা তিনশো পঞ্চাশ আসন বিশিষ্ট। তিনশত আসনের সংসদ সদস্যরা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন এবং এই নির্বাচনের জন্য আছে আলাদা সাংবিধানিক সংস্থা, যার নাম বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন। 

বাংলাদেশের সংবিধান সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক সংবিধান। বাংলাদেশের সরকার কীভাবে চলবে, তা সংসদ সদস্যদের মতামত ও ভোটের মাধ্যমে হয় এবং সংখ্যা গরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তা আইন হিসেবে পাস হয় জাতীয় সংসদে। এরপরে বাংলাদেশের নির্বাহী বিভাগ তা বাস্তবায়ন করে এবং বাস্তবায়নে ত্রুটিবিচ্যুতি হলে বিচার বিভাগে তার বিচারকার্য হয়। শুধু এতে গণতন্ত্র আসে না, এর সাথেও আমাদের দেখতে হয় সরকার জনগণের জন্য তাদের দায়িত্ব কতটুকু বাস্তবায়ন করছে? 

আমাদের দেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকারের কথা বলা আছে, যেগুলো সাংবিধানিক অধিকার। সংবিধানের ২৬ থেকে ৪৪ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত এ কথা বলা আছে। এই সব অধিকার বাস্তবায়ন করা সরকারের দায়িত্ব আর কর্তব্য। সংসদ নির্বাচনের পূর্বে জনপ্রতিনিধিরা জনগণের সাথে অঙ্গীকার করেন, তারপরে ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে এগুলো বাস্তবায়ন করেন, অন্যথায় পরবর্তীকালে নির্বাচনে জনগণের ভোট হারিয়ে হেরে যান। আসলে এখানে জনগণের প্রকৃত ক্ষমতা আসে। 

এছাড়া একটি সরকার ব্যবস্থা চলে আপামর জনগণের প্রদত্ত রাজস্ব আয়ের উপর। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় জনগণ যেমন সরকার তৈরি করে, তেমনি বিভিন্নভাবে রাজস্ব দিয়ে উক্ত সরকার পরিচালনা করে। 

এতক্ষণ যা তুলে ধরা হলো, তা গণতন্ত্রের তত্ত্বীয় বিষয়। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে লেখা আর বাস্তবতা এক হয় না। পৃথিবীতে গণতন্ত্র একদিনে বা সহজে আসেনি। পূর্বে রাজতন্ত্র ছিল, পরবর্তীকালে রাষ্ট্রের জনগণ অত্যাচারী রাজাদের শোষণ থেকে মুক্তির জন্য গণতান্ত্রির সরকার ব্যবস্থায় আসে। গণতন্ত্র এসেই যে জনগণের দুঃখ-কষ্ট দূর করে দিয়েছে তা কিন্তু না, পূর্বের অবস্থা থেকে অনেক ভালো অবস্থায় এসেছে। 

আমাদের দেশে কয়েকশ বছর পূর্বে রাজতন্ত্র ছিল। ইংরেজদের কাছে ১৭৫৭ সালে হেরে তারপরে ইংরেজ শাসনে চলে যায়। ঠিক একশ বছর পরে ভারত শাসন আইন হয়ে গণতান্ত্রিক ধারা শুরু হয়। কিন্তু ইংরেজরা তো আমাদের কাছে ভিনদেশি। পরবর্তী সময়ে নানা আন্দোলন ও ত্যাগের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হয়। কিন্তু এরপরেও আমাদের দেশে গণতন্ত্র আসেনি। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর জন্য গণতান্ত্রিক সরকার আসেনি। বরং বাঙালি দমানোর জন্য সামরিক শাসন এসেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। এর পরে প্রথম যে সংববিধান তৈরি হয়, সেটিই ছিল বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের লিখিত দলিল বা প্রমাণ। তারপরে আবার এই দেশের জনগণ শাসকদের কাছে ধাক্কা খেয়েছে। গণতন্ত্র হারিয়েছে, আবার আন্দোলনের মাধ্যমে উদ্ধার করেছে। বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতাকামী, তাই গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা এই দেশে অত্যন্ত প্রিয়।

আমাদের দেশের মানুষ এখনও সচেতন নয়। দেশের সাংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৭ তে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক শিক্ষার কথা বলা আছে। কিন্তু ক’জন জানি এ অধিকারের কথা? শুধু সংগ্রাম করে গণতন্ত্র আনলে হবে, সচেতন হয়ে গণতন্ত্রের স্বাদও গ্রহণ করতে হবে।  

এমনও হয় যে, অনেকে ভোট পর্যন্ত দেন না। ভোট না দিলে গণতন্ত্র আসে না, আর গণতান্ত্রিক সরকার অচল হয়ে যায়। যা প্রকৃতপক্ষে আমাদেরই ক্ষতির কারণ। আর শুধু ভোট দিয়ে সরকার তৈরি করে দিলে জনগণের দায়িত্ব শেষ হয় না, সরকারকে সাহায্য ও সহযোগিতা করতে হয়, সেটা ব্যক্তিগতভাবে কিংবা সম্মিলিতভাবে। এজন্যই বলা হয়েছে, ‘গণতান্ত্রিক সরকারের মূল শক্তি জনগণই’। জনগণকে যেমন ভোট দিতে হয়, তেমনি রাজস্ব দিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করা উচিৎ। নিজের মতামত প্রকাশ করা উচিৎ। বিশ্বাস করা যায়, এভাবেই একদিন বাংলাদেশে শ্রেষ্ঠ গণতন্ত্র চর্চার জায়গা হবে। 

 

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

ঢাকা/মাহি