ক্যাম্পাস

‘করোনা পরীক্ষার গোলমালটা কোথায়’

পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এই কারণে যে, ফেসবুকে দেখলাম বাংলা একাডেমি নতুন বানান রীতি প্রচলন করেছে। কোন কোন বানান নতুন করে সংশোধন হয়েছে বা পরিবর্তন হয়েছে তা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারিনি, তাই বেশ শঙ্কিত। কিন্তু ফেসবুকের মন্তব্যগুলো বেশ মজা দিয়েছে। 

অনেকেই মন্তব্য করছেন, বাংলা একাডেমির সংশোধিত বানান তারা ছোটবেলাতেই লিখেছেন। কিন্তু নম্বর কেটে নেওয়া হয়েছে। তাই সেই নম্বর যেন এখন ফেরত দেওয়া হয়। তাদের যুক্তি সঠিক বলেই মনে হয়।

কতজন যে জীবনে এই ভুল বানানের জন্য কম নম্বর পেয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। কতবার যে বাংলা বানান পরিবর্তন হলো সেটাও বলতে পারব না। আমাদের দেশে এরকম সব কিছুই কেমন জানি গোলমেলে ভাবে চলে এবং চলতেই থাকে। একই অবস্থা করোনা পরীক্ষা নিয়ে। এটা নিয়ে কত রাজনীতি, কত অর্থনীতি, কত দুর্নীতি তা বলে কি লাভ? সত্যি কি সেলুকাস এই দেশ? অনেককেই জিজ্ঞেস করেছি, যারা এরকম দুর্নীতি করে তারা কি করোনাকে ভয় পায় না?

ছোটবেলার বইতে একটি গল্প ছিল। সবাই কম-বেশি জানে তাও একটু পুনরাবৃত্তি করছি। পারস্য কবি শেখ সাদির এলাকার মক্তবে একজন ওস্তাদ প্রয়োজন। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ গেলেন তার কাছে একজন যোগ্য ওস্তাদের জন্য। উনি একজন ভালো এবং জ্ঞানী ওস্তাদ দিলেন। ওস্তাদের একটাই দোষ। ছাত্রদের খুবই বকাবকি করেন। আগে যেটা আমাদের দেশেও অনেক দেখা যেত। এটা অভিভাবকরা মেনে নিতে পারেননি। ফলাফল ওস্তাদ পরিবর্তন করতে হবে বলে শেখ সাদিকে বলা হলো।

শেখ সাদি দিলেন একজন নরম স্বভাবের এবং উনি পড়ালেখা জানেন না ভালো মতো এমন ওস্তাদ। অভিভাবকরা খুশি। কিছু দিন গেলেই উল্টা ফল। ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করে না। কী ব্যাপার? দেখা গেলো, ওস্তাদ ছাত্রদের পড়ান, ‘গোলেমালে যায় যত দিন’। অভিভাবকরা পড়লেন চিন্তায়। বুদ্ধিও পেয়ে গেলেন। সব অভিভাবক ছেলেমেয়েদের শিখিয়ে দিলেন, যখন ওস্তাদ এটা পড়াবে, তখন তোমরা সুর না মিলিয়ে বলবে, ‘এইভাবে খাবেন কত দিন?’

যেদিন এই ঘটনা ঘটল সেদিনই ওস্তাদ পগার পার। সে রকম হচ্ছে করোনা পরীক্ষা নিয়ে। এই যে একবার পজিটিভ আবার নেগেটিভ, আবার পজিটিভ কিভাবে সম্ভব? গোলমালটা কোথায়? ইতালির গণমাধ্যম ‘সান্দিয়াগো ইউনিয়ন ট্রিবুন’ এর তথ্য অনুযায়ী, ১১২ জন বাংলাদেশি যাত্রীর মধ্যে ৩৭ জন করোনা পজিটিভ ছিল। এর ফলে সেখান থেকে ১৬৫ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হলো। একইসঙ্গে আগামী ৫ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ইতালি যাওয়া বন্ধ করা হয়েছে।

শুধু তাই নয়, সে দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বাংলাদেশিদের সত্যিকারের ভাইরাস বোমা বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইতালির স্বনামধন্য গণমাধ্যম ‘ইল মেসাজ্জেরো’ ৭ জুলাই ‘বাংলাদেশ থেকে ভুয়া করোনামুক্তির সনদ নিয়ে ইতালি আসছে’ এমন শিরোনাম দিয়ে পত্রিকার প্রথম পাতায় এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই কথার মধ্যে সত্য কতটুকু? দায় কার? খুব সহজে যাদের রিপোর্ট তাদের উপর দায় চাপানো যায় কিন্তু সেটা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত?

ইতোপূর্বেও এই ঘটনা ঘটেছে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াতে যাওয়া ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও এই ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু তখন এত পাত্তা দেওয়া হয়নি। পাত্তা দেওয়া উচিত ছিলো। যিনি সনদটি দিলেন বা সই করলেন তার কোনো দায় নেই? আমিও করোনার সনদে সই করি। আমার কি কোনো দায়বদ্ধতা কাজ করবে না?

রিয়েল টাইম পিসিআর পদ্ধতিটি কিছুটা সংবেদনশীল পরীক্ষা। অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করে আসে ফলাফল। যতই ইচ্ছা থাক না কেনো ভুল নেগেটিভ আসতে পারে যদি কেউ এই পরীক্ষায় দক্ষ না হয়। করোনা পরীক্ষার প্রথম ধাপ, নমুনা সংগ্রহ। ধরে নিলাম, ইতালিগামী ব্যক্তি যদি ভাগ্যবান হন তাহলে তার নমুনা সঠিকভাবে সংগৃহীত হল। না হলে প্রথমেই আপনি একটি ভুল নেগেটিভ ফলাফল পেলেন। এর পরের ধাপ হলো ল্যাবে নমুনা জমা পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ভিটিএমে নমুনা নিতে বলা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সব ক্ষেত্রে সম্ভব না হওয়ায় নরমাল স্যালাইনেও নিতে হচ্ছে। সংস্থাটির মতে, ভিটিএমে প্রাপ্ত নমুনা তিন দিনের মধ্যে পরীক্ষা করতে বলা হয়েছে। এর বেশি সময় লাগলে নমুনাকে নিয়ম মেনে সংরক্ষণ করতে হয়।

কীভাবে নমুনা সংরক্ষণ করলে সঠিক হবে সে তথ্যটি বলতে পারেন একজন অণুজীববিজ্ঞানী। একজন অণুজীববিজ্ঞানী জানেন নমুনাকে দীর্ঘসময় সংরক্ষণের উপায়। যেকোনো নমুনা যথাসময়ে বা যথানিয়মে সংরক্ষণের ওপর নির্ভর করে ফলাফল পজিটিভ আসা। অণুজীববিজ্ঞানীকে দায়িত্ব দিলেন না তাহলে কীভাবে আসা করবেন সঠিক ফলাফলের? ভাববেন কেন অণুজীববিজ্ঞানীদের কথা বলা হচ্ছে? কারণ হলো একমাত্র অণুজীববিজ্ঞানীরাই যে কোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া যত খারাপই হোক না কেন তাকে আপন করে নেয়। এরকমই শিক্ষা দেওয়া হয় তাদের।

ধরে নেওয়া হলো নমুনা সঠিক উপায়ে সংরক্ষণ হয়েছে। এখন নমুনা থেকে আরএনএ পৃথক করার পালা। বিভিন্ন উপায়ে ও পরিমাণ নিয়ে এই কাজটি করা যায়। নমুনাকে সঠিক নিয়মে ঝাঁকুনি দিতে হয় ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘ভরটেক্সিন’। এই কাজটিও চার চারটি বছর ধরে অণুজীববিজ্ঞানীরাই অনুশীলন করেন। কাজের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পাইপেটিং। পাইপেটিংয়ে দক্ষ ব্যক্তিই পারেন ভালো আরএনএ পৃথক করতে।

পুনরায় আপনাকে ভাগ্যবান ধরে নিয়ে পাইপেটিং সঠিকভাবে হয়েছে বলে এগিয়ে গেলাম। পিসিআর দিতেও লাগে পাইপেটিং। এই পর্যায়ে অণুজীববিজ্ঞানীর পাশাপাশি বায়োটেকনোলজি বা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারের গ্র্যাজুয়েটরাও পারে। শেষ ধাপে ফলাফল দেওয়ার পালা। অনেকেই জানেন না, পিসিআর-এর ফলাফল সরাসরি গ্লুকোজ মাপার মতো না। এক্ষেত্রেও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। যদি এমন কাউকে নেওয়া হয় যে এই বিষয়ে অভিজ্ঞ না, তাহলে পজিটিভ বা নেগেটিভ ভুল করতে পারেন।

এতগুলো জায়গায় যদি একজন রোগীকে ভাগ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়, তাহলে ভাবুন ভাগ্য কত সময় সহায় হবে? তাহলে ফলাফল যা আসার কথা সেটা না আসলে সেই দায় কার? ল্যাবগুলোতে যারা কাজ করছেন তাদের? কয়েক দিন আগে এক ল্যাবে আমাকে পরামর্শক হিসাবে নিয়ে গেলো। কীভাবে ল্যাব তৈরি করতে হবে সেটা তাদের বললাম। আমার কথা না মেনেই ল্যাব বানিয়ে ফেলেছেন তারা। জানিনা পরীক্ষা করছে কি-না। করোনা ল্যাব যে অন্য ল্যাবের তুলনায় আলাদা এটাই যেন বুঝতে চায় না অনেকে।

তাহলে দায় কার? সঠিক জায়গায় সঠিক ব্যক্তি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কি-না সেটা দেখাও জরুরি। দেশে বর্তমানে অনেকগুলো মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে করোনা পরীক্ষা হচ্ছে। কিন্তু কোন ল্যাবে কিভাবে মান নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে তার কোনো ডাটা নাই। তবে বিদেশগামীদের ক্ষেত্রে শুধু আইইডিসিআর, আইসিডিডিআরবি, সিএইচআরএফ- এর মতো প্রতিষ্ঠানের ফলাফলকে গ্রহণ করা উচিৎ ছিল। তাহলে বিদেশে যে সুনাম ক্ষু্ণ্ণ হলো সেটা থেকে বাঁচা যেত। সেই সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি কমিয়ে আনা যেত। এই দিকটিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষভাবে নজরে দেওয়া জরুরি। ল্যাবগুলোতে সঠিকভাবে অণুজীববিজ্ঞানীদের উপস্থিতিতে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে কিনা অথবা যেখানে নাই সেখানে অণুজীববিজ্ঞানীদের নিয়োগ প্রদান করে মান নিয়ন্ত্রণ করা যেত কি-না এসব বিষয় দেখভাল করতে হবে।

 

লেখক: চেয়ারম্যান, অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ ও সহযোগী প্রধান, করোনা গবেষণা দল, জিনোম সেন্টার, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

যবিপ্রবি/মাহফুজ/মাহি