আবুল মনসুর আহমদের প্রবন্ধ ‘আয়না’ একটি অনবদ্য সৃষ্টি। সাতটি গল্পে উঠে এসেছে বাংলার কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, গণক, তান্ত্রিক এবং ওঝার প্রতি অর্ধ-শিক্ষিত ও নিরক্ষর মানুষের অবিচল বিশ্বাসের কথা। ‘ছেলেবেলা এক গণক বেটা বলিয়াছিলেন যে, আমার মৃত্যু পানিতে ডুবিয়া! সেই হইতে আমি নদী চুলোয় যাক, পুকুরেও গোসল করিতাম না।’
সুরেন বাবু গো-দেওতা কা দেশ গল্পের মূল চরিত্র। সামাজিক ও ধর্মীয় সম্প্রীতি ভাঙনে ধর্মব্যবসায়ীদের প্রভাব, হিন্দু-মুসলিম অস্পৃশ্যতা ও বিভেদের ফলে ইংরেজ শাসন দীর্ঘায়িত হওয়া, ধর্মে উঁচুতলা-নিচুতলার জন্ম নানা কুসংস্কারের পরিচয় মেলে এখানে।
ধর্মান্ধতার বিষে আবদ্ধ লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, উচ্চবর্ণের হিন্দু, মুসলমান, ক্ষমতাসীন দলের কারণে ধর্মীয় জটিলতার রূপ নেয়। আধ্যাত্মিক অনাচার, নেতাদের অস্বাভাবিক বাগাড়ম্বর দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়। জাতীয় সংকট তৈরি করে। লেখক বলেন, ‘দুধের পরিমাণ যেভাবে দ্রুত বৃদ্ধি পাইতেছে, তাতে অতি শীঘ্র পর্বত ডুবিয়া যাইবে।’
ধর্মীয় উপাসনালয় থেকে ধর্মীয় উস্কানি সাধারণ, নিরক্ষর ও গরীব জনগণের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণার বিষবাষ্প ছড়ায়। এই বৃহৎ গোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে বছরের পর বছর ক্ষমতালিপ্সুরা গদিতে থাকেন। উগ্র ধর্মান্ধতা থেকে মুক্তচিন্তার মানুষ এবং সুশীল সমাজ নিরাপদ নয়। লেখক বলেছেন, ‘আমি অবাক হইয়া চারিদিকে তাকাইলাম। দেখিলাম ক্ষিপ্ত ষাঁড়গুলো শির বাঁকাইয়া আমাকে গুঁতাইতে আসিতেছে।’
নায়েবে নবী গল্পে দেখা যায়, গ্রামের সরদার মৌলবী সুধারানরী সাহেব এবং প্রতিদ্বন্দ্বী মৌলভী গরিবুল্লাহর প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব সংঘাতের চিত্র। সংগঠনকেন্দ্রিক শক্তির প্রকাশ ‘স্কুল ছাত্রের তুর্কি টুপি পোড়ানোর ঘটনা’। জানাজায় সিনা বা শির বরাবর দাঁড়ানোর মতো সাধারণ বিষয় নিয়ে দুই মৌলভীর বাকযুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত জুতা ছুঁড়াছুড়ি, ইমামতি নিয়ে কাড়াকাড়ি, উভয়ের গোপন তথ্য লোকসম্মুখে ফাঁস করে বেইজ্জতি হওয়া, পরে মাতব্বরের আদেশে জানাজা পড়ানোর মতো হাস্যকর ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে এই গল্পে।
মধ্যস্থতার মধ্যে সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরে আসে। ধমের্র সামান্য-ঠুনকো বিষয় নিয়ে আক্রোশ, সামজিক বিশৃঙ্খলা, সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে তা স্পষ্টভাবে লেখক বুঝিয়েছেন। এই গল্পে দেখানো হয়েছে বাংলার আর্থ সামাজিক বাস্তবতার চিত্র।
আরেকটি গল্প মুজাহেদিন। ধর্মীয় সম্পীতি বজায় থাকা একটা গ্রামে বহিরাগত মওলানা মানুষের মধ্যে ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে শান্তিপূর্ণ বসবাসকে উস্কে দেয়। মওলানাদের ইংরেজি শিক্ষার প্রতি অনীহা এবং ধর্মীয় দূরদর্শিতার অভাব ফুটে উঠেছে এই গল্পের শুরুতেই। গ্রামে স্কুল না থাকায় একটা স্কুল স্থাপন করা হলো। স্কুল সম্পর্কে মওলানা বললেন,‘স্কুলসমূহে এমন ধর্ম বিরুদ্ধে গাঁজাখোরি গল্পও শিক্ষা দেওয়া হয় যে, দুনিয়াটা গোল এবং ঘুরিতেছে। কোরআন- পাকে আল্লাহু-জল্লুশান সাফ ফরমাইয়াছেন: পৃথিবী ফরাসের মতো চ্যাপটা এবং স্থির। ছেলেবেলা হইতে কোরআনের খেলাপ শিক্ষাদান করিলে কেন নাস্তিক হইবে না? ইহার জন্য দায়ী ছেলেরা নয়, ছেলেদের অভিভাবকেরা।’ এরকম বক্তব্য স্কুল বিমুখ করতে না পারায়। হানাফি-মোহাম্মাদি মাজহাবের ঘৃণ্য সম্প্রদায়িকতার জন্ম দিলেন।
গ্রাম্য অশিক্ষিত সরল-বুদ্ধি লোকেরা টের না পেলেও কিছু মানুষ প্রতিবাদ করলেন ‘বহু কণ্ঠে আপত্তি উঠিল, মোহাম্মাদিদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলবেন না। কে বেহেশতী কে দুজখী, সে বিচার করবেন খোদা।’ শেষ পর্যন্ত এতে উভয় অঞ্চলের মানুষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
লেখক দেখিয়েছেন সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহতা। ‘গ্রামের বহুলোককে গ্রেফতার করিয়া হতাহতদের লাশ আসামিদের কাঁধে তুলিয়া পুলিশ যে রাস্তায় কোতোয়ালির দিকে রওনা হইল, সেটা ছিল হিন্দু পাড়া। তখন সে পাড়ায় স্বামী বিবেকানন্দের সভাপতিত্বে বিধাবা বিবাহ প্রচলন ও অস্পৃশ্যতা বর্জনের প্রস্তাব গৃহীত হইতেছিল। সভার লোক খানিকক্ষণ সভার কাজ স্থগিত রাখিয়া সারি বাধিয়া দাঁড়াইয়া কোমরে- দড়ি- বাঁধা- কাঁধে- লাশের- ডুলি- বওয়া মুসলমানদের মিছিল দেখিল।’
লেখকের লেখা প্রসঙ্গে এমিরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছেন, ‘পরশুরাম হিন্দু দেবদেবী নিয়ে অনেক কিছু বলেছেন, হিন্দু সম্প্রদায় তা সহ্য করেছে। আবুল মনসুর আহমদের দুঃসাহস সেদিন সমাজ সহ্য করেছিল। আজ কোনো সম্পাদক এমন গল্প ছাপতে সাহস করবে কিনা এবং সমাজ তা সহ্য করবে কিনা, সে-সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে। আবুল মনসুরের আক্রমণের লক্ষ্য কোনো ব্যক্তি, ধর্ম বা সম্প্রদায় নয়। তাঁর বিদ্রোহ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। ‘আয়না’ প্রকাশের এতকাল পরেও মনে হয়, এমন একটি গ্রন্থের প্রয়োজন আজও সমাজে রয়ে গেছে।
আয়নার শেষ গল্প ‘বিদ্রোহী সংঘ’। বিদ্রোহী সংঘের সদস্যদের ব্রত ‘আইন-কানুন, বিধি-নিষেধের বেড়ি ভাঙ্গাই আমাদের জীবনের ব্রত। এজন্য আমরা প্রাণপাত করতে প্রস্তুত। আমরা নিজেরা কোনও আইন-শৃঙ্খলা বা বিধি নিষেধ মানি না। সমস্ত গতানুগতিকতা বিসর্জন দিয়ে চলি।’
বিদ্রোহীতে রাজনৈতিক কৌশল এবং হিন্দু মুসলমানের দ্বিধাবিভক্তির ধর্মীয় প্রভাব প্রকাশ পেয়েছে। বিপ্লবে নীতি-নৈতিকতা না থাকলে বেশিদূর যাওয়া যায় না। বিপ্লবে নীতি-নৈতিকতা দিয়ে যদি অন্তর্জাত কোনো অবস্থান না থাকে তাহলে যেকোনো মতাদর্শের বিপ্লব দাঁড়ায় না বা জাতীয় সংকট মেকাবেলা করা সম্ভব হয় না। এ প্রসঙ্গে এম এন রায়ের প্রাসঙ্গিককতা, ‘নীতি-নৈতিকতা সংক্রান্ত বিচারবুদ্ধিও সক্ষমতা যদি খোদ মানুষের মধ্যে অন্তর্জাত অবস্থায় না থাকে তাহলে স্বাধীনতার মৌলিক তাড়নার পরিপূরণ হতে পারবে না। কেননা মানুষকে তাহলে অবশ্য-অবশ্যই কতিপয় নিয়মকানুন অথবা রীতির কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে হবে।’ (ম্যাজিক লণ্ঠণ-১৮৭)।
১৮৯৮ সালে ময়মনসিংহের ধানীখোলায় জন্মগ্রহণ করেন এই লেখক। আবুল মনসুর আহমদ সমাজ, জনগণ ও রাজনীতি সচেতন লেখক। তিনি নিজে স্বচ্ছ জবাবদিহিতার রাজনীতি করেছেন। বাংলার ইতিহাসে অগ্নিঝরা লেখক এবং রাজনীতিক তিনি। ‘অনেক সহকর্মী লইয়া আমি অন্ধকার রাতে সাইকেল কাঁধে করিয়া মাইলের পর মাইল বালুচর পার হইয়াছি...একঘুমে আমি ছাব্বিশ ঘন্টা কাটাইয়া ছিলাম...।’
তরুণ প্রজন্মের কাছে আবুল মনসুর আহমেদ এক উজ্জল নক্ষত্র। যার ক্ষুরধার লেখা মনের রোগের এন্টিবায়োটিকের কাজ করে। মানুষ নিয়ে ভাবায়। ধর্মের দীক্ষা দেয়। সর্বশেষ বলতে হয়, আজকে করোনা যুগে আবুল মনসুর আহমেদের ‘ফুড কনফারেন্স ও আয়না’র প্রাসঙ্গিকতা অপরিসীম।
লেখক: সদস্য, রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি।
রাজশাহী/মাহফুজ/মাহি