কিছু কিছু বিষয় অনেক সময় ব্যাখ্যার বাইরে থেকে যায়। চাইলেও সেই রহস্য ভেদ করা যায় না। স্রষ্টার আপন খেয়ালেই হয়তো রয়ে যায় সেসব। বৃষ্টি এবং নারী মানব ইতিহাসের সবচেয়ে পুরনো রহস্য আর আগ্রহের অন্যতম অনুষঙ্গ। বৃষ্টি যেমন প্রকৃতিকে সতেজ করে তোলে, নারীও তার স্বকীয়তায় সুন্দর করে তোলে একটি পরিবার ও সমাজ।
বৃষ্টি এবং নারীর মাঝে অদ্ভুত মিল রয়েছে। তাদের কোমলতায় যেমন ধূসর প্রান্তর জেগে ওঠে, আবার তাদের কঠোরতায় তছনছ হয়ে যায় সবকিছু। ইতিহাসের পাতায়, বড় বড় ঘটনার পেছনে বৃষ্টি এবং নারীর কারণই বেশি পাওয়া যায়। বৃষ্টি যেমন মরু প্রান্তরেও গুলবাগিচার জন্ম দিয়েছে, তেমনিভাবে ধ্বংসও করেছে আপন খেয়ালে। অপর দিকে নারী যেমন ভালোবাসা দিয়ে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছে, তেমনই যুদ্ধের কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছে নারী। বৃষ্টি যেমন জমিতে ফুল, ফসল ফলায় তার কোমলতায়, নারী মায়ের রূপে তেমন করেই তার সন্তান পরিবার গড়ে তোলে।
সাহিত্যের প্রতিটি বিভাগেই বৃষ্টি এবং নারীর অবদান রয়েছে। এদুটো ছাড়া সাহিত্য যেন কল্পনাও করা যায় না। সাহিত্যিকরা বৃষ্টি এবং নারীকে সাজিয়েছেন হাজারো রূপে, হাজারো ঢঙে। আবেগের সবথেকে গভীরতম স্থানে বৃষ্টি এবং নারীর বসবাস। বৃষ্টি যেমন আবেগের সূত্র তৈরি করে, আর নারী সেই আবেগের পূর্ণতা দেয়। তাইতো বৃষ্টি কিংবা নারীর মহিমায় নিতান্ত সাধারণ মানুষও হয়ে ওঠে কবি। প্রতিটি পুরুষ জীবনে কখনো না কখনো কবিতা সাজায় বৃষ্টি কিংবা নারীর আকাঙ্ক্ষায়।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘বর্ষার দিনে’ কবিতায় যেন প্রতিটি মানবের মনের আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরেছেন। বৃষ্টি এবং নারী যে একই সুতোয় বাঁধা তার বাস্তবতাই ওঠে এসেছে সেখানে-
‘এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়-
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়।।’
কবিগুরুর এ আকুতিই জানান দেয় বৃষ্টি এবং নারী কতটা আপন।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘বর্ষা বিদায়’ কবিতায় বৃষ্টি এবং নারীকে এক করে ফেলেছেন। এরা যেন তার কাছে একই। বৃষ্টিই তার কাছে নারীর রূপ হয়ে গেছে। আর তাইতো তিনি লিখেছেন-
‘ওগো বাদলের পরী! যাবে কোন্ দূরে ঘাটে বাঁধা তব কেতকী পাতার তরী!
ওগো ও ক্ষণিকায়, পুব-অভিসার ফুরাল কি আজ তব?
পহিল ভাদরে পড়িয়াছে মনে কোন্ দেশ অভিনব?’
কাজী নজরুল ইসলাম তার অনুভূতি দিয়ে বৃষ্টিকে এঁকেছেন নারীর রূপে। রূপায়িত করেছেন মনের মাধুরি মিশিয়ে।
‘ওগো ও কাজল মেয়ে,
উদাস আকাশ ছলছল চোখ তব মুখে আছে চেয়ে।
কাশফুল সম শুভ্র ধবল রাশ রাশ শ্বেত মেঘে
তোমার তরীর উড়িতেছে পাল উদাস বাতাস লেগে।
ওগো জলের দেশের কন্যা। তব ও বিদায় পথে
কাননে কাননে কদম-কেশর ঝরিছে প্রভাত হ’তে।
তোমার আদরে মুকুলিতা হয়ে ঊঠিল যে বল্লরী
তরুর কণ্ঠ জড়াইয়া তারা কাঁদে নিশিদিন ভরি।’
বৃষ্টি যতটা প্রয়োজন জীবন ধারণের জন্য, নারীও ঠিক ততটাই প্রয়োজনীয়। তাইতো ধর্মও নারীকে সম্মানীত করেছে তার যোগ্যতায়। নারীর মাতৃত্ব রূপের কাছে জান্নাতও হেরে গেছে বলেই তাকে মায়ের পায়ের নিচে দেওয়া হয়েছে। নারীর প্রেয়সী রূপের কাছে অন্যসব সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়।
তাইতো নারীকে সম্মানে, ভালোবাসায় আগলিয়ে রাখতে হয়। তবেই তো নারী বৃষ্টি হয়ে সাজিয়ে তোলে পৃথিবীকে। নারীই পারে আগলিয়ে রেখে সুখের নীড় গড়ে তুলতে। কিন্তু নারীকে ভালোবাসা, সম্মানে ভূষিত করতে না পারলে বৃষ্টির মতো সব ভাসিয়ে দিতেও পারে।
লেখক: শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী।
ঢাকা/মাহি