ক্যাম্পাস

গাভী বিত্তান্ত: যে কারণে শিক্ষাঙ্গনে আজও প্রাসঙ্গিক 

আহমদ ছফা এমনই এক সাহসী লেখক, যার লেখায় উঠে এসেছে সমাজের নানা অসঙ্গতি। তিনিই প্রথম দেশের সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। কবি নজরুল আর কাজী মোতাহার হোসেনের পর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হিসেবে বলা হয় তাকে। পড়াশোনা ও শিক্ষকতা উভয়ই করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

‘মোঘল সম্রাটেরা যেখানে যেতেন রাজধানী দিল্লিকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন, তেমনি আবু জুনায়েদও দিনে একবেলার জন্য গোটা বিশ্ববিদ্যালয়কে গোয়ালঘরে ঢুকিয়ে ফেলতেন। দিনে দিনে গোয়ালঘরটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃৎপিণ্ড হয়ে উঠল। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে এটাই পৃথিবীর একমাত্র গোয়ালঘর, যেখান থেকে আস্ত একটি কর্মপদ্ধতি পরিচালিত হয়’- উদ্ধৃতিটি আহমদ ছফার ‘গাভী বিত্তান্ত’ উপন্যাস থেকে নেওয়া।

বাংলাদেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়, যার পরতে পরতে গৌরবান্বিত ইতিহাস, সব আন্দোলন সংগ্রামের আতুর ঘর; বলা হয় এই শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠকে। সেই বিদ্যাপীঠে হঠাৎ এক বিস্ময়কর ঘটনার জন্ম দিয়ে গল্পের সূত্রপাত। আবু মুহম্মদ জুনায়েদ, যিনি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন ডিপার্টমেন্টের একজন শিক্ষক। গোবেচারা প্রকৃতির লোক তিনি।

বিভাগের বাইরে বন্ধু বলতে নেই বললেই চলে। অথচ ভাগ্য সুপ্রসন্ন! শিক্ষকরা দলাদলি আর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে যখন মাতোয়ারা, তখন মিরাকলের মতো করে প্রথমে ডোরাকাটা দলের প্রতিনিধি পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মনোনীত হন তিনি। উপাচার্য হওয়ায় তার জীবনে আসে আমূল পরিবর্তন। তিনি নিজের ভেতরের পরিবর্তনের চাইতে বাইরের পরিবর্তনের দিকেই যেন বেশি উদগ্রীব। ভেতরের দূর্বলতাকে পোশাক দিয়ে ঢাকার যেন তার আপ্রাণ চেষ্টা। সহজ সাদামাটা জীবন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠতে লাগল। ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী সবার অতসব বৈধ, অবৈধ চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে তিনি মাঝেমধ্যে অস্থির হয়ে পড়েন।

শিক্ষকগণ শিক্ষকতার চাইতে রাজনীতিটাকেই আবশ্যক মনে করেন। রাজনীতি করে রাতারাতি পদোন্নতি, প্রভোস্ট, ডিন হওয়া যায়। তাই সুবিধেমত গঠন করেছে সাদা, হলুদ, নীল, ডোরাকাটা নামক দল। ছাত্ররাও রাজনীতিতে পিছিয়ে নেই! জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে লেজুড়বৃত্তি করে চলে ছাত্র রাজনীতি। সরকারি ও বিরোধীদলগুলো যে কোনো প্রয়োজনে তাদের ব্যবহার করে। ছাত্রদের হাতে কলমের পরিবর্তে অস্ত্র দেখা যায়। ছাত্ররা প্রায়ই রক্ত-সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। কখনো পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলন, কখনো পরীক্ষা আগানোর। কিংবা সেশনজট কমানোর আন্দোলন আবার কখনো শিক্ষক, কর্মচারীদের বেতনের আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় স্থবির হয়ে পড়ে।

রসায়ন বিভাগের এক শিক্ষিকা দীলরুবা খানম। পূর্ববর্তী উপাচার্য আবু সালেহের এক পেয়ারা শিক্ষকের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক। হঠাৎ সেই উপাচার্য তার এক আত্মীয় সচিবের মেয়ের সঙ্গে ঐ শিক্ষকের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে দেন। আর তাতেই তিনি দীলরুবা খানমের রোষানলে পড়েন। দীলরুবা খানম ঐ উপাচার্যের সমর্থিত হলুদ দলকে নির্বাচনে হঠানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা  চালান। বর্তমানে আবু জুনায়েদ যে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য। শুধুমাত্র দীলরুবা খানমের রূপের মোহে পড়ে তিনি ডোরাকাটা দলে ভীড়েছিলেন। সেই দীলরুবা খানমই আবু মুহাম্মদ জুনায়েদকে ডোরাকাটা প্রার্থী করেন।

এখন সেই দীলরুবা খানমই তাকে তুলুধোনা করে। যেখানে সেখানে দর্জির দোকানের ডামী বলে প্রচার করে বেড়ান। উপাচার্য হিসেবে তার অযোগ্যতার প্রমাণ মিলতে  থাকে। আবু জোনায়েদের জীবন তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। নিয়মিত অফিসে যান, আসেন। নিজের দলের লোক তাকে অপদার্থ বলে সমালোচনা করেন, বিরূদ্ধপক্ষের লোক তাকে ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ এনে জনমত তৈরি করেন। সরকার ধাতনী দেন, বিরোধী দল দেন হুমকি।

পারিবারিক জীবনেও আবু মুহাম্মদ জুনায়েদ সুখি নন। স্ত্রী নুরুন্নাহার বানুর বাপের টাকায় তিনি পড়াশোনা করেছিলেন। সেই খোঁটা বিয়ের পর থেকে আজ অবধি শুনেই আসছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কন্ট্রাক্টর শেখ তবারক আলী, যিনি স্ত্রী নুরুন্নাহার বানুর বাবার সহকারি ছিলেন, হলের কাজের তদারকি করতে গিয়ে দেখা হয় আবু জুনায়েদের সঙ্গে, হয় জানাজানি।

দীর্ঘদিন ধরে মনের মধ্যে জমে থাকা গাভী পোষার শখটা লজ্জা ভুলে শশুরতুল্য শেখ তবারক আলীকে বলে ফেলেন। আর তিনিও নুরুন্নাহার বানুর বাবার কৃতজ্ঞতার প্রতিদানস্বরূপ তরিঘরি করেই ভিসির বাংলোয় একটা দৃষ্টিনন্দন গোয়ালঘর আর উন্নত জাতের গাভীর ব্যবস্থা করে দেন। শুনতে বেমানান হলেও  পরবর্তীতে সেই গোয়ালঘর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রশাসনিক, রাজনৈতিক সব কর্মকাণ্ড চলতে থাকে।

আবু মুহাম্মদ জুনায়েদ মনে করতে থাকেন, তার ক্ষমতার খুব প্রয়োজন। এখানে টিকে থাকতে সৎ থাকার চাইতে ক্ষমতা অর্জন সহজ এবং আবশ্যক বলে মনে হতে থাকে। নিজ স্বার্থের প্রয়োজনে আবু মুহাম্মদ জোনায়েদকে প্রায়ই কোনো শিক্ষক তোষামোদ করতে আসেন। তারা তাকে প্রকৃতি প্রেমিক বলে আখ্যা দেয়। কেউ কুকুর কেউবা পাখি আবার কেউবা গাভী নিয়ে এক গাল প্রশংসা বাক্য ছুঁড়ে দেয়।

আর উপাচার্যও তার দল ভারী করার জন্য তাদের দলে ভেড়াতে থাকেন। এই গোয়ালঘরে সন্ধ্যা হলেই আড্ডা জমে উঠতে থাকে। গোয়ালঘরে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টির নানান গুরুত্বপূর্ণ কাজের অনুমোদন হতে থাকে। আবু জুনায়েদের কাছে গাভীটাই ধ্যান-জ্ঞান হয়ে উঠল। এক সন্ধ্যায় রসায়ন বিভাগের শিক্ষক মুস্তাফিজুর রহমান রসায়নে বিশ্বকাঁপানো ব্রেক-থ্রু রিসার্চের আউটপুট কপি দেখাতে নিয়ে আসলেন। কিন্তু গাভীর চিন্তায় ব্যস্ত আবু জুনায়েদের তা দেখার সময় মেলেনি।

এদিকে নুরূন্নাহার বানু ঐ গাভীর মধ্যে তার সতীনের রূপ দেখতে শুরু করেন। জন্ম হয় নতুন করে পারিবারিক অশান্তি। নুরূন্নাহার বানু ঐ গাভীকে মেরে ফেলার জন্য ফন্দি আঁটতে থাকেন। পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রদূত জুনায়েদ সাহেবের গাভীপ্রেমে মুগ্ধই হয়েছিলেন বোধ হয়। অচিরেই আমেরিকার ৫১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দেবার ডাক আসে তার। সঙ্গে বিরাশি লাখ টাকার হাতছানি।

উপন্যাসটি পড়লে বিশ্ববিদ্যালয়টির নানান অসঙ্গতি সম্পর্কে জানা যাবে। উপন্যাসটি ব্যঙ্গাত্মকরূপে লিখেছেন আহমদ ছফা। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়টির যেখানে শধুমাত্র বিশ্বমানের জ্ঞান অর্জন নয় বরং নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করে বিশ্বব্যাপী  ছড়িয়ে দেয়ার কথা। সেখানে কিভাবে দিনদিন ঐতিহ্যবাহী  বিশ্ববিদ্যালয়টি অপরাজনীতি ও দুর্নীতির করালগ্রাসে ছেয়ে যাচ্ছে, সেটিই দেখাতে চেয়েছেন তিনি। আজও যেন তার লেখা ‘গাভী বিত্তান্ত’ সমাজে প্রাসঙ্গিক।

শিক্ষার্থী; লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

কুবি/মাহফুজ/মাহি