ক্যাম্পাস

‘আপা কলেজ খুলবো না, আর কি আয়বেন না?’

জীবনের গল্প ‘বন্ধ গেইটে’

এখন রাত-দিনের মধ্যে তেমন ব্যবধান দেখি না। রাতের অন্ধকারে খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে যেমন শহরের নিস্তেজ গলিপথ দেখা হয়, দিনের প্রখর রোদেও তাই দেখি। শুধু কল্পনাজুড়ে ঘুমের সময়কে রাত বলে মনে হয়। আর দিনের সূচনা হয় মালবাহী ট্রাকের ভেঁপু শব্দে। নতুবা জানালার ফাঁকে ঝাঁঝালো রোদে।

কলেজ বন্ধ, কোচিং নেই। এ সময় বের হওয়ায় পাছে ভয়। আর অপ্রয়োজনে বাইরে বের হবোই বা কেন? তাই প্রথম প্রথম চার দেয়ালে আবদ্ধ জীবন অ্যাকুরিয়ামের মাছের মতো অনুভব হতো। কয়েক মাসে অভ্যাসের পরিবর্তন হলো বৈকি।

আজ প্রয়োজন ছাড়াই বের হবো। অপ্রয়োজনেও বলা যায় না। তবে মা শোনার পর থেকে বারবার বারণ করেই যাচ্ছেন। কিন্তু সিফাত তো এক নাছোড়বান্দা ছেলে। সকাল থেকেই তার একের পর এক ফোন। না গেলে রেহাই নেই। সুজন আর নোভাও ফোন করেছে যাবে বলে।

বিকেল ৩টায় বাসা থেকে বের হয়ে দেখি রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। শুধু মুদির দোকান আর ঔষধের দোকান ছাড়া বাকি সব তালা ঝুলানো। রাস্তায় আগের মতো কোনো যানজট নেই। আন্দরকিল্লা মোড়ে কয়েকটি রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। এক বাস হেলপার আমার দিকে হাতের ইশারায় ডাক ছাড়ছে। এ চকবাজার, বহদ্দারহাট, কালুরঘাট আসেন-আসেন...।

তাড়াতাড়ি বাসে উঠে দেখি বাসেও একই দশা। এক সময় যে বাসে ঝুলে যাওয়াটা দুষ্কর ছিল, সেখানে আজ আমিসহ মাত্র পাঁচ জন যাত্রী। তবে না হওয়ারই কথা। এক দিকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা তার ওপর আবার জীবনের ভয়। ভয় শুধু বাইরে নয়, ভেতরেও। সামান্য কাশি উঠলেই পুরো শরীর শিউরে ওঠে। কাশির আঘাত গিয়ে ঠেকে বুকে। তবু কাশি এলেও চেপে রাখি। না হলে মা অস্থির হয়ে যায়।

হঠাৎ খক্ক-খক্ক-খ করে পেছনের সিটের বৃদ্ধটা কেশে ওঠে। আতঙ্ক ভরা চোখে সবাই তাকায় তার দিকে। কিন্তু সে কাশে আর কাশে। মিনিট কয়েক কাশার পর থামে। আবার হাঁফায়। এমন সময় সামনের সিট থেকে এক ভদ্রলোক চেঁচিয়ে বলেন, ‘কি সব বাসে ওঠে! না- এ ড্রাইভার থামান’- এই বলে মাঝ পথে নেমে যায় ভদ্রলোক।

অন্যদের মতো আমার চোখে-মুখেও ভয়ের ছাপ। তবে আমার পথ আর বেশি নেই- সামনেই প্যারেডের কর্নার। কিন্তু কে জানে বৃদ্ধটিও আমার সঙ্গে হয়তো প্যারেড কর্নারেই নেমে যাবে। ভেবেছিলাম পিছু নেবে, তবে না। সে রাস্তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। আর বৃদ্ধের ময়লা ভরা পাঞ্জাবিটা বাতাসের তালে তালে উড়ছে। তার চেহারায় ব্যস্ততার চিহ্ন। কিছু দূর হেঁটে গিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখি, বৃদ্ধটি আর ওখানে নেই। নিমিষেই কোথায় যেনো মিলিয়ে যায়।

কেয়ারি শপিংমলের সামনে আসার পর কেউ যেন আমার নাম ধরে ডাকলো, ‘আদিব, এ আদিব’। হ্যাঁ, ওটা নোভার ডাক। পরক্ষণে সুজন, ‘আদিব দাঁড়া, আমরা এখানে’- এই বলে ওরা রাস্তা পেরুতে থাকে।

এতক্ষণ তিন জনেই কেয়ারির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। সিফাত ও সুজনের মুখে মাস্ক পরিধান করা। এই ধুলোবালির শহরে তাদের আগে কখনো এভাবে দেখিনি। হয়তো আমাকেও দেখেনি কেউ। সরকারি নীতিমালা না হয় দূরে থাক, আজ এ পরিবেশে মাস্ক পরে না এলে নিজেকে নিজেই অপরাধী বোধ করতাম। নোভার তো আর ভিন্নতা নেই। তার মুখে আগেও নেকাব থাকতো এখনো আছে। তাই আলাদা মাস্কের প্রয়োজন নেই ওর।

আমরা প্যারেডের পাশ দিয়েই হাঁটছি। এখানেও ফুটপাত নিস্তব্ধ। রাস্তার ধারে কেউ বসে নেই। পুলিশের কড়া নজরদারি আছে। আবার জীবনের ভয়। এখানে বসাটাও বোকামি। এখন রাস্তার ধারে ফুচকাওয়ালা আর তার চারপাশে ছেলে-মেয়েদের জড়ো হয়ে হৈ-হুল্লোড় আজ যেন দুর্লভ। তবুও আজ আমরা কিসের টানে ফিরে এলাম, কিসের নেশায় এই পথে হাঁটছি?

কলেজের প্রবেশদ্বারে গিয়ে দেখি গেইট বন্ধ। লকারে দুটি বড় বড় তালা ঝুলছে। ভেবেছিলাম মাঠের ভেতরে বসবো। নোভা না থাকলে হয়তো যে কোনোভাবেই প্রবেশ করতাম। এখন আসাটা বিফল। আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকাও উচিৎ বলে মনে হয় না।

কোথায় যাবো। বিষয়টা নিয়ে যখন ভাবছি এমন সময় বন্ধ গেইটের ভেতর থেকে চিৎকার ভেসে আসে। ‘আপা-ভাইয়া-আপা’। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে দেখি, মাঠের ভেতর থেকে জেসমিন আর রানা দৌঁড়ে আসছে। ওরা ভাই-বোন। প্রতিদিন কলেজ শেষে দুজনেই গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। হাত পেতে ইশারা দেয়, টাকা চায়। আজ টাকা নয়, বোধ হয় এত দিনের জমানো কথাগুলোই বলবে ওরা।

কিন্তু না আজও গ্রিলের ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে টাকা চাওয়ার ইঙ্গিত পাই। পকেট থেকে খুঁজে কয়েকটি ভাঙতি টাকার নোট দিলাম। সিফাত, সুজনও দিলো। নোভার ব্যাগ থেকে বেরিয়ে এলো বিশ টাকার নোট। টাকাগুলো নিয়ে জেসমিন নোভার কাছে করুণ স্বরে জানতে চায়- ‘আপা কলেজ আর খুলবো না? আপনেরা আর আয়বেন না?’ নোভা নিরুত্তর। আমরাও নির্বাক। কেউ যে জানি না কলেজ কখন খুলবে। জানি না কখন ফিরবো পুরনো পৃথিবীতে?

বেলা শেষে বাসায় ফিরছিলাম। পথ যত এগোয় জেসমিনের শেষ কথাই কানে বাজে- ‘আপা কলেজ খুলবো না, আপনেরা আর আয়বেন না?’

লেখক: রাঙামাটি সরকারি কলেজ।

ঢাকা/মাহফুজ/মাহি