ক্যাম্পাস

কিশোর গ্যাং: নির্মূল হবে যেভাবে

সেদিন রাত আনুমানিক ১০টা। অফিস থেকে বাসায় ফিরছিলাম। বাসার সামনের গলিতে এক মা ও বোনের কান্নার আহাজারি শুনতে পাই। অনেকেই তাদের ঘিরে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, কান্না করছেন কেনো? বললো, আমার ভাইয়ের জন্য অনেক রক্ত লাগবে। খুব দ্রুত রক্তের ব্যবস্থা করতে হবে।

আজহারি দেখে আমি জানতে চাইলাম, কত ব্যাগ লাগবে? কিন্তু কত ব্যাগ লাগবে তা তার জানা নেই। রক্তের গ্রুপও জানা নেই তাদের।

জানতে পারলাম কয়েকজনের সঙ্গে মারামারি করেছে তার ভাই জব্বার। মারামারির এক পর্যায়ে জব্বারকে ছুরি দিয়ে আঘাত করেছে প্রতিপক্ষ গ্রুপ। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। পরদিন ঘুম ভাঙতেই শুনি এলাকায় একজন খুন হয়েছে। জানা গেলো হাসপাতালের ওই ছেলেটাই মারা গেছে।

জব্বারের বয়স ১৫ বছর। সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে তাদের দুই গ্রুপে মারামারি হয়েছিল। সবুজবাগের রাজারবাগ কারখানায় প্রিন্টিংয়ের কাজ সেরে বাসার সামনে আসে জব্বার। প্রথমে ইমনের সাথে তর্কাতর্কি। এরপর ঘটনাস্থলে আসে ইমনের ভাই ইয়াসিন। এক পর্যায়ে ইয়াসিন পকেট থেকে ছুরি বের করে আঘাত করে জব্বারকে। গুরুতর আহত হলে হাসপালে ভর্তি করা হয়। পরদিন সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় জব্বার। আমার এলাকার সাম্প্রতিক ঘটনা এটি।

এর বাইরেও নিয়মিত এসব ঘটনা পত্রিকা, অনলাইন মাধ্যম কিংবা টিভি’র খবরে জানতে পারি। উত্তরখানের খ্রিস্টানপাড়া ডাক্তার বাড়ি মোড় এলাকায় একটি ব্যাটারিচালিত রিকশার চাকা থেকে পানি লাগে হৃদয় নামে এক কিশোরের গায়ে। এ ঘটনা ঘিরে সোহাগ নামের এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। তুচ্ছ ঘটনায় জেরে রাজধানীর চকবাজারে নাদিম নামের এক যুবককে প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। নারায়ণগঞ্জের ইস্পাহানি এলাকায় দুই কিশোর গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ সময় স্থানীয় দুই কিশোর ১৮ বছরের নিহাদ ও ১৫ বছরের জিসান শীতলক্ষ্যায় ঝাঁপ দিলে তাদের মৃত্যু ঘটে।

কথিত এসব কিশোরদের অধিকাংশই নামি বা বেনামি গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত। কিশোর গ্যাং নামে তারা আলোচিতও বটে। এসব কিশোররা অনেক সময় তুচ্ছ কারণেও মারামারি করে। এক এলাকার ছেলে অন্য এলাকায় গেলে মারধর করা হয়। কাউকে গালি দিলে বা যথাযথ সম্মান না দেখালে, এমনকি বাঁকা চোখে তাকানোর কারণেও মারামারি হয়। নারী সম্পর্কিত এবং সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব থেকেও অসংখ্য মারামারি হয়।

কিশোরদের মধ্যে অস্ত্র বহন করার প্রবণতা রয়েছে। অনেকেই আবার মাদকাসক্ত। ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে তারা। বিশ্লেষকরা মনে করেন, মাদক সেবন ও অস্ত্রের দাপটসহ অপরাধ প্রবণতা বাড়ার কারণে কিশোর গ্যাং তৈরি হচ্ছে। এছাড়া এখনকার শিশু-কিশোররা পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যথেষ্ট মনোযোগ না পাওয়াতেও এই সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে আরও বেশি।

কখনো বন্ধুদের মাধ্যমে গ্যাংগুলোতে ঢুকছে তারা। মাদক ও অস্ত্রের যোগান সহজেই পেয়ে যাচ্ছে তখন। প্রলুব্ধ হচ্ছে এবং অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে সমাজে। কিশোরদের মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ গঠনে যে শিক্ষার দরকার পারিবারিক ভাঙ্গনসহ বিভিন্ন কারণে সেটা তারা পরিবার থেকে পাচ্ছে না। সনাতন সমাজ থেকে শিল্প সমাজে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যে পরিবর্তন হয়েছে তা মোকাবিলায় আমাদের সে ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি এখনো।

ফলে যারা একেবারেই নিম্নবিত্ত শ্রেণির পরিবার থেকে এসেছে, তারা বাইরে বা বস্তিতে বেড়ে উঠছে। পশ্চিমা দেশে সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ও শিক্ষা পদ্ধতিতে অনেক আগেই পরিবর্তন এনেছে। আমরা তা পারিনি। এটা সরকারের একার না বরং সবার জন্যই বড় রকমের সামাজিক সমস্যা।

শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। রাষ্ট্র ও সংস্থার তত্ত্বাবধানে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে চাহিদা কি সেটাও চিহ্নিত করে সে ধরণের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে শিশু পরিচর্যাকেন্দ্র তৈরি করতে হবে। নৈতিকতার শিক্ষা শিশুরা যাতে পরিবার থেকে পায় সে জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। স্কুলের পাঠ্য বইয়েও নৈতিকতার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে গুরুত্বসহকারে।

এদের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ার পাশপাশি প্রত্যেক পরিবারকে সচেতন হতে হবে। তাদের সন্তানরা কোথায় যায় কার সঙ্গে মেশে তার খোঁজ রাখতে হবে। কিশোররা স্মার্টফোন চালালে সেটার তাদারকি করতে হবে পরিবারকে। যাতে স্মার্টফোন কালচার সর্বনাশ ঘটাতে না পারে।

এছাড়া, কিশোরদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ সমাজের রীতিনীতিগুলো ধারণ করাতে পরিবারকেই ভূমিকা রাখতে হবে। রাজনৈতিক বড় ভাইদের ব্যাপারেও সচেতন হতে হবে। সমাজে অপরাধী বৃদ্ধি পাওয়া থামাতে হবে এখনই। পরিবারে কিশোরদের একাকী বা বিচ্ছিন্ন না রেখে যথেষ্ট সময় দিতে হবে তাদেরকে। খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার সুযোগ দিতে হবে শিশুদের। তাহলেই হয়তো কিশোরদের মধ্যে এসব অপরাধ প্রবণতা কমবে। কিশোর গ্যাংয়েরও বিলুপ্তি ঘটবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ।