ক্যাম্পাস

গ্রামীণ সমাজে ছেলে-মেয়ের অবস্থান 

প্রকৃতির এক অকৃত্রিম সৌন্দর্যে ভরপুর আমাদের এই বাংলাদেশ। সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা, ছায়া সুনিবিড় পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে দেশটি গঠিত। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ায় এর অর্থনীতির মেরুদণ্ড এখনও কৃষির উপর নির্ভরশীল। গ্রাম হচ্ছে কৃষির প্রাণকেন্দ্র এবং প্রতিটি মানুষের অস্তিত্বের শিকড়, যেখানে সবাই প্রাণখুলে বিশুদ্ধ, নির্মল বাতাস ও প্রকৃতির নানা রূপ বদল ও সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হতে পারে। 

ডিজিটাল বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী। বর্তমান যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে গ্রামের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। তবুও কোথায় যেন একটা পার্থক্য রয়ে গেছে। আমার আশেপাশে ঘটে যাওয়া অনেক কিছুই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দেখার, শুনার বা অনুধাবন করার সুযোগ হয়েছে। তাই এখন আমি গ্রামের ছেলে-মেয়েদের অবস্থান এবং গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার কিছু চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

গ্রামে পরিবারের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছেলেরাই নেন। তবে কিছু কিছু পরিবারে মেয়েদের মতামতও নেওয়া হয়, তবে তা হাতেগোনা কয়েকটি পরিবার মাত্র। সাধারণত একটা মেয়েকে যতটুকু খোলসে আবৃত থাকতে হয়, গ্রামের মেয়েদের তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ খোলসে আবৃত থাকতে হয়। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের রেস্ট্রিকশন তো আছেই। সমাজে চলাফেরার জন্য কিছু নির্দিষ্ট রীতিনীতি, নিয়ম-কানুন আছে মেনে চলতে হয়। কোনো মেয়ে যদি এসব নিয়মের কোনো একটু ভঙ্গ করেন, তাহলে তার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করার জন্য আমাদের তথাকথিত সমাজ প্রস্তুত থাকেন। ঠিক একই কাজ ছেলেরা করলেও তাদের খুব বেশি কিছু বলা হয় না। মেয়েদের ছোটখাটো অপরাধ যেখানে ক্ষমার অযোগ্য, সেখানে ছেলেদের অপরাধগুলো তেমন গুরুত্বই দেওয়া হয় না। 

মেয়েরা সাধারণত কিছু রেখে কিছু ঢেকে কথা বলতে পছন্দ করেন। এসব মেয়েরা ঘরকুনো হয়, সহজ সরল প্রকৃতির হয় এবং বাইরের জগৎ সম্পর্কে তাদের তেমন কোনো ধারণা থাকে না। ফলে, তারা প্রতিযোগিতামূলক জগৎ থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে। আজও অনেকে উচ্চশিক্ষা বলতে বাড়ির আশেপাশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে অধ্যয়ন করাকে বোঝায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তারা উদাসীন। তবে এই উদাসীনতার কারণ পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা, অভিভাবকদের আন্তরিকতার অভাব, পরিবারের সদস্যদের অসহযোগী মনোভাব। তবে, একটা ছেলে চাইলেই এসব অতিক্রম করতে পারেন, তাকে কেউ অসহযোগিতা করেন না।

গ্রামে মেয়েরা সাধারণত মায়ের সঙ্গে ঘরে গৃহস্থালির কাজ করেন এবং ছেলেরা বাবার সঙ্গে কৃষিকাজসহ অন্যান্য কাজ করেন। বেশিরভাগ অভিভাবক প্রতিদিন বাচ্চাদের স্কুল বা কলেজে যাওয়ার বিষয়ে অনেক সচেতন থাকেন। স্কুল, কলেজ থেকে বাচ্চারা পালিয়ে বাড়িতে আসলে ইচ্ছামতো পিটুনি দিতে ভুলেন না, কিন্তু বাড়িতে বাচ্চারা ঠিকঠাক পড়াশোনা করছে কি-না সেটা তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখেন না। তবে গ্রামের একটা বিষয় খুবই মর্মান্তিক হচ্ছে দিন দিন। সেটা হচ্ছে যদি প্রেমঘটিত কোনো খবর পরিবারের কাছে আসে, তাহলে সেই ছেলে বা মেয়ের অবস্থা খুবই খারাপ হয়। 

যদি মেয়ে প্রেম করার খবর সবাই জানেন, তাহলে পরিবারের ছোট থেকে বড় সবাই অপমান করেন ইচ্ছামতো। বড়রা শাসন করেন আর যতপ্রকার অ্যাকশন নেওয়ার সব নেবেন। কিছু সাধারণ কথা আছে যা সবাইকে শুনানো হয়, এগুলো হচ্ছে, তুই এত নিচে নেমে যাবি আমরা ভাবতে পারিনি, অবশেষে তুই আমাদের বংশের মানসম্মান, ইজ্জ্বত সব ডুবালি, তোর জন্য সমাজের সবার কাছে আজ মাথা নিচু হয়ে গেলো ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার কখনও কখনও মারপিটও করেন। তবে শারীরিকভাবে আঘাত না করলেও মানসিভাবে প্রচুর যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় মেয়েদের। 

সব চেয়ে বেশি কষ্টের বিষয় হচ্ছে, শতকরা ৮০ শতাংশ মেয়েদের বাল্যবিবাহ এজন্যই গ্রামে হয়ে থাকে। যে মুহূর্তে মেয়েদের অনেক বেশি যত্ন নিয়ে ভালোভাবে কাউন্সিলিং করা দরকার, সে মুহূর্তে তা-না করে অনেক মেয়েকে পরিবার থেকে বিয়ে দেওয়া হয়। তখন মেয়েরা না পারে কিছু বলতে, না পারে সহ্য করতে। এভাবেই ঝরে পড়ে অনেক প্রতিভাবান শিক্ষার্থী। তবে ছেলেরা যদি প্রেম করেন, তাহলে তাদেরও হালকা শাসন করা হয়। তবে, যতই শাসন করা হোক না কেন, একটা সময় এসে শান্তনার বাক্য বলবে ‘ছেলে মানুষ ২/১টা প্রেম করতেই পারে। অথচ একই অপরাধের জন্য মেয়ের সঙ্গে কী আচরণ করা হলো? এটাই হলো গ্রামীণ সমাজ। 

এসব নিয়ে যতই কথা বলি না কেন, কোনো লাভ হবে না। কারণ, আমাদের তথাকথিত সমাজে ছেলেদের সম্পত্তি এবং মেয়েদের সম্মান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেদিন বাবা-মা ছেলেদের সম্পত্তি এবং মেয়েদের সম্মান না ভেবে উভয়কে সন্তান হিসেবে দেখতে শুরু করবেন, সেদিনই সমাজের এই চিত্র পরিবর্তন হবে, এর আগে কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ (২য় বর্ষ), কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

কুবি/মাহি