ক্যাম্পাস

আবার যদি ইচ্ছা করো...

আজ ২০ অক্টোবর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাবাজারে অবস্থিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ছাত্রী হল ‘বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল’। 

দীর্ঘ ১০ বছর প্রতীক্ষার পর এবার বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে চালু হলো হলটি। এই হলের পেছনের ইতিহাস অনেক লম্বা। বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে সেই স্মৃতিবিজড়িত হল আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিলেন আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখা জবি শিক্ষার্থী ঊর্মি ইসলাম ইমা।

হ্যালো মা তুই আন্দোলনে যাস? না, মানে...আজকেই শুধু...

থাক! আর মানে মানে করতে হইবো না। তুই যে আন্দোলনে যাস আর এই কাঠফাটা রোদে রাস্তার মইধ্যে বইসা স্লোগান দেস, সবই জানি। সে ঠিক আছে কিন্তু তুমি জানলা কেমনে? কিচ্ছুক্ষণ আগে টিভিতে তোরে স্লোগান দিতে দেখছি। ওহ! সমস্যা নেই, মা। ওখানে সিনিয়র ভাই-বোনেরা আছেন। তারা আমাদের যথেষ্ট নিরাপদে রাখেন।

তোদের সিনিয়র যারা, তারা তো এখন হল দিলেও উঠতে পারবে না। তারপরও আন্দোলনে আসে? কী যে বলো তুমি! তারাই তো আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। তাই আমরা সাহস পেয়েছি। তুমি টিভিতে দেখছো না? কত ছাত্র-ছাত্রী পিচ ঢালা রাস্তায় এই রোদের মধ্যে বসে আন্দোলন করছে।

‘হু’

এদের কেউই তো হলে উঠতে পারবে না।  আর আন্দোলনকারী সবাই এটা জানে। তবু দেখ, হাজার হাজার শিক্ষার্থী আন্দোলনে আসছে।  কষ্ট করছি আমরা আর তার সুফল ভোগ করবে পরবর্তী ব্যাচগুলো। এটাই তো নিয়ম মা!

হুম...।  দেখ, কিছু হয় কি-না।  মা, দেখো। এবার ঠিকই আমাদের দাবি মেনে নেবে। সাবধানে থাকিস।

এমনি ছিল হল আন্দোলনের সময় আমাদের প্রায় প্রতিটি জবিয়ানের পারিবারিক কথোপকথনের চিত্র। নতুন প্রজন্ম কতটুকু বিশ্বাস করবে জানি না। তবে, তৃতীয় দিন আন্দোলন শেষ করে যখন বাসায় ফিরলাম, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পরিবর্তনটা লক্ষ করলাম নিজেই। মনে হয়েছিল, দীর্ঘ দিন ধরে যত্ন করে কেউ আমার মুখ-গলা-হাতের চামড়ায় আগুনের আঁচে একটু একটু করে পুড়িয়ে যাচ্ছে। স্লোগান শেষে কণ্ঠেও যেন নেমে এসেছে রাজ্যের ক্লান্তি। ধীরে ধীরে কণ্ঠস্বর ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে এলো। এত কিছুর পরেও কোথায় যেন একটা অদম্য স্পৃহা কাজ করছিল। 

বিভাগের সিনিয়ররা সবসময় ছায়ার মতো পাশে থেকেছেন। সাহস জুগিয়েছেন। মিডিয়া কাভারেজ ছিল। এত কিছুর পর হলের ঘোষণা এলো। আর তারই পরিণতি আজকের তোমাদের এই ‘বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রী হল’। 

‘তোমাদের হল’ শব্দটা আমি সচেতনভাবেই ব্যবহার করেছি। কারণ, আন্দোলনকারী ব্যাচগুলোর মধ্যে আমরা ছিলাম সবচেয়ে জুনিয়র, আর এখন সবচেয়ে সিনিয়র। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সোনালি দিন ম্রিয়মাণ হয়ে আসছে। হলে আমাদের একটা রাতের জন্যেও জায়গা হবে না জানি। তাতেও কোনো আক্ষেপ নেই।

প্রিয় জুনিয়র, 

মনে রেখো, আক্ষেপ তখন হবে, যদি কখনো মনের  ভুলেও হলটা একটু ঘুরে দেখতে যাই। আর তোমরা যদি বে-খেয়ালে একটু বিনয়ের সঙ্গে বসতেও না বলো। তখন আমি হয়তো অতীতে ফিরে যাবো। আন্দোলনের সেই দুর্গম পথের স্মৃতি সেদিন আমার চোখে দু’ফোঁটা অশ্রুকে যদি আমন্ত্রণ করে, তবে বুঝে নিও, সে দায়ভার একান্তই তোমাদের।

‘‘আবার যদি ইচ্ছা কর আবার আসি ফিরে দুঃখসুখের-ঢেউ-খেলানো এই সাগরের তীরে ॥ আবার জলে ভাসাই ভেলা,  ধুলার 'পরে করি খেলা গো, হাসির মায়ামৃগীর পিছে ভাসি নয়ননীরে ॥ কাঁটার পথে আঁধার রাতে আবার যাত্রা করি, আঘাত খেয়ে বাঁচি নাহয় আঘাত খেয়ে মরি। আবার তুমি ছদ্মবেশে আমার সাথে খেলাও হেসে গো, নূতন প্রেমে ভালোবাসি আবার ধরণীরে ॥’’

ইতি, সাবেক হওয়ার পথে এক সিনিয়র। ১১তম ব্যাচ, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

জবি/মাহি