ক্যাম্পাস

নাম না জানা ঝরনার খোঁজে

পার্বত্য এলাকা চট্টগ্রাম। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান আর চট্টগ্রাম এই চারটি জেলার প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছোট বড় নানা পাহাড়। আর পাহাড়ের কথা আসলে চলে আসে ঝরনার কথাও। 

এই অঞ্চলে পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে দেখা মেলে বেশ কিছু ঝরনা। বর্ষাকালে তুলনামূলক বেশি দেখা মেলে এসব ঝরনার। কারণ, ঝরনার সৃষ্টি হয় মূলত পাহাড়ের বিভিন্ন স্তরে জমে থাকা পানি থেকে। আর বর্ষাকালে বৃষ্টি হয় বলে ঝরনার সংখ্যাও বেড়ে যায়। 

পাহাড়ের উপর থেকে চুইয়ে পড়া পানির নিচে পতিত হওয়ার ছন্দময় শব্দ আর তার সৌন্দর্য মুগ্ধ করে সবাইকে। তাই সেই সৌন্দর্যের সুধা উপভোগ করার জন্যই পাহাড়ের উঁচু-নিচু কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে মানুষ ঝরনার কাছে ছুটে যায়। 

আমি আরাফাত বিন হাসান, থাকি এই পাহাড়ঘেরা চট্টগ্রামেই। করোনার ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় গ্রামের বাড়ি ফটিকছড়িতে আছি বেশ কয়েক দিন। এসএসসির পরে এত দীর্ঘ সময় গ্রামের বাড়িতে থাকা হয়নি আর। তাই দম বন্ধ হয়ে আসছিল যেন।

এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে জন্ম হলেও আমাদের বাড়ি সমতলে। তবে বাড়ি থেকে ৮ কিলোমিটার পূর্বে ও ৮ কি.মি. পশ্চিমে বেশ কিছু পাহাড় রয়েছে। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি পশ্চিম দিকের পাহাড়ে একটি ঝরনা রয়েছে। তবে এই ঝরনার চেয়েও এর পাশের একটি পাথরের কথা সবার মুখে বেশি শোনা যায়। নাম সালামি পাথর। এই পাথরটিকে ঘিরে এলাকায় নানা মুখরোচক গল্প প্রচলিত আছে। 

কিন্তু দুঃখের বিষয় শৈশব-কৈশোর গ্রামে কাটালেও বাড়ির কাছের এই ঝরনা কিংবা সেই বিখ্যাত পাথর কোনোটাই দর্শন হয়নি আমার। কবিগুরু সম্ভবত এমন কোনো কারণেই লিখেছিলেন ‘দেখা হয়নি চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে দুপা ফেলিয়া একটা ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু।’ সে যাই হোক, সম্প্রতি আমরা কয়েকজন মিলে সেই নাম না জানা ঝরনার খোঁজে বেরিয়েছিলাম।

সাত জনের দল আমরা। আমি ছাড়া দলে ছিল আমার ছোটভাই সায়েম, রামিম, সাইমন, আরমান, ফারুক ও জুয়েল ভাই। সিদ্ধান্ত হলো সকাল ৬টায় পাড়ার খেলার মাঠ থেকে যাত্রা শুরু হবে। পাহাড়ি পথ, চাইলে অর্ধেক পথ সিএনজি চালিত অটোরিকশা কিংবা ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে যাওয়া যেত, কিন্তু আমরা পায়ে হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রতি ঘণ্টায় তিন কিলোমিটার করে হাঁটলেই আট কিলোমিটার দূরের ঝরনায় তিন ঘণ্টার আগে পৌঁছা সম্ভব। 

কথামতো নির্দিষ্ট দিনে ভোরে যাত্রা শুরু করি আমরা। প্রথম দুই ঘণ্টা টানা হেঁটে সকালের নাস্তা করি ঘরকাটা নামক এলাকায়। নাস্তা বলতে চা, পাউরুটি আর কলা ছাড়া এখানকার দোকানে আর তেমন কিছু পাওয়া যায় না। পাহাড়ি জনপদ, শহুরে সুযোগ-সুবিধা স্বাভাবিকভাবেই এখানে থাকার কথা নয়। নাস্তা সেরে আমরা পুনরায় যাত্রা শুরু করি। মূলত এই ঘরকাটা এলাকাটা থেকেই শুরু হয় পাহাড়ি পথ। তাই এই অংশটা পাড়ি দেওয়া সবচেয়ে কঠিন। এক একেকটা পাহাড় ১০০°-১১০° খাড়া, আর এই খাড়া পথ দিয়েই পথচলা আমাদের। তাছাড়া পাহাড়ি পথ, চারদিকে ঘাস আর জঙ্গল, স্বাভাবিকভাবেই জোঁকের উৎপাত বেশি। সাপের ভয় তো আছেই। তবে কঠিন পাহাড়ি পথ পাড়ি দেওয়ার খাটুনি সুদে-আসলে পুষিয়ে দিতে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ের সৌন্দর্য আর পথে পথে বানরের পালের নানা কসরতই যথেষ্ট।     

এভাবে এক ঘণ্টা হাঁটার পর আমরা গিয়ে পৌঁছি একটা খালে। স্থানীয়ভাবে হিঙ্গুলী খাল নামে পরিচিত এটি। এই খালটিই ফটিকছড়ি আর মিরসরাই উপজেলাকে পৃথক করেছে। অর্থাৎ আমার নিজ উপজেলা ফটিকছড়ির শেষ সীমানা এটি। খালে পানি কম, সবচেয়ে বেশি হাটুসম, তবে বেশ স্বচ্ছ। এই খাল ধরেই এগোতে হবে আমাদের। খাল দিয়ে কিছুটা পূর্ব দিকে এগোতেই আমাদের স্বাগত জানায় খালের মাঝে থাকা কিছু বড় বড় পাথর। সেই পাথরগুলো পেরিয়ে আমাদের চোখে পড়ে বড় আরেকটি পাথর। খালের ধারের এই পাথরটিই সালামি পাথর নামে পরিচিত।  স্থানীদের কাছে বেশ মর্যাদাপূর্ণ এটি, তাদের মতে অতীতে কোনো একসময় কোনো এক আউলিয়া ধ্যানে বসতেন এই পাথরে। 

‘হিঙ্গুলী খাল’ দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে বয়ে গেছে। আর সালামি পাথরের ঠিক সোজা দক্ষিণ দিক থেকে একটি পাহাড়ি ছড়া দিয়ে কিছু পানি এসে মিলিত হচ্ছে খালটাতে। ঝরনা দেখতে হলে এবার আমাদের এগোতে হবে এই পাহাড়ি ছড়া দিয়ে। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর পাহাড়ি এই ছড়াটি ধরে কিছুদূর এগোতেই আমাদের নাকে আসে উৎকট এক দুর্গন্ধ।  দলের কেউ কেউ বললো হয়তো ছড়ার পানিতে কোথাও মাছ মরে আছে, তার গন্ধ হতে পারে এটি। কিন্তু আরেকটু এগোতেই ছড়ার পানিতে দেখা যায় একটি মৃত পশু। অর্ধেক পানিতে ডুবে আছে আর অর্ধেক পানির উপরে, পানির উপরের অংশ সম্পূর্ণ পচে গেছে। ততক্ষণে সেই দুর্গন্ধের উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেলো।  আর পশুটার মাথার উপর শিং দেখে নিশ্চিত হওয়া গেলো মৃত এই পশুটার নাম হরিণ। 

এভাবে আরেকটু এগোতেই আমরা শুনতে পাই ঝরনার শব্দ। ধীরে ধীরে পৌঁছে যাই ঝরনার খুব কাছে। পানি পতনের শব্দের সঙ্গে গাছের ডালে লেপ্টে থাকা ঝিঁঝিঁ পোকার চিৎকারের শব্দ মিশে তৈরি হয়েছে এক কাব্যিক সুর। সেই সুরের তালে তালে আমরা দলবেঁধে হারিয়ে যাই প্রকৃতির অসীম সৌন্দর্যের অতল সাগরে। ঝরনার পানিতে গা ভিজিয়ে অন্তত কয়েক মুহূর্তের জন্য আপনার মনে হবে জীবন আসলেই সুন্দর। আর জীবনের চেয়ে বেশি সুন্দর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ঝরনার পানি গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য। 

যেভাবে যাবেন- 

চট্টগ্রাম শহর থেকে বাসে ফটিকছড়ি, ফটিকছড়ি থেকে বাস বা সিএনজি চালিত অটোরিকশা যোগে নারায়নহাট আসা যাবে। নারায়নহাট থেকে হাসনাবাদ হয়ে হেঁটে যাওয়া যাবে ঝরনা পর্যন্ত। নারায়নহাট থেকে দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। তাছাড়া ঘরকাটা পর্যন্ত সিএনজি চালিত অটোরিকশা অথবা ভাড়ায় চালিত মোটর সাইকেলেও যাওয়া যাবে। 

চট্টগ্রাম শহর থেকে বারৈয়ারহাট-হেঁয়াকো হয়ে শান্তিরহাট-তাঁরাখোঁ দিয়ে যাওয়া যাবে।

সতর্কতা-

শারীরিকভাবে শক্তিশালী না হলে যাওয়ার দরকার নেই, পাহাড়ের ঢালু পথ ওঠা-নামা খুবই কঠিন। তাছাড়া পাহাড়ি পথে জোঁক আর সাপের উৎপাত তো আছেই।

লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সি। 

চট্টগ্রাম/মাহি