ক্যাম্পাস

বিশ্বজয়ের পথে স্বপ্নচূড়ার মেয়েরা   

হেমন্তের প্রথম দিকে আকাশে চলছে ঘোলাটে সব মেঘের খেলা। খানিকটা ঝড় হবে মনে হয়, তাই বলে কি আটকে যাবে মানব জীবনের দুঃসাহসিক যাপন! ঠিক সকাল ৮ টা, দিরাই উপজেলার ভাঙ্গাডহর গ্রাম থেকে নৌকা ছেড়ে দেয় দিরাই বাজারের উদ্দেশে। উত্তাল ভরাম হাওরের দানবরূপী ঢেউয়ের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মাঝারি ধরনের একটি ছোট্ট নৌকাটি। প্রায় আধ ঘণ্টা পর নৌকা পৌঁছালো আপন মঞ্জিলে। 

নৌকা থেকে ওঠে আসা হাওর পাড়ের মানুষের দলটি ছুটে চলছে দিরাই বাজারে দিকে। তাদের সঙ্গে থাকা লিজা নামের মেয়েটিও চলছে নিজ গন্তব্যে। নৌকা থেকে প্রায় এক ঘণ্টা পায়ে হেঁটে মেয়েটি পৌঁছে তার আপন ঠিকানা দিরাই স্টেডিয়ামে ৷ সেখানে তার মতো আরও প্রায় শ'খানেক মেয়ে আছে। যারা লিজার মতোই বিভিন্ন হাওর আর ভাঙা রাস্তা পাড়ি দিয়ে এখানে এসেছে। উদ্দেশ্য ফুটবল খেলা। 

এত রক্ষণশীল একটা এলাকার মেয়েরা ফুটবল খেলবে! প্রথমে খটকা লাগাটাই স্বাভাবিক। তবে লিজাদের বেলায় কথাটা আজ পাক্কা সত্যিতেই রূপ নিয়েছে। 

বর্ণনা করছিলাম, ভাটির দেশ সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার স্বপ্নচূড়া এফসি স্পোর্টিং ক্লাবে ফুটবল খেলা একদল স্বপ্নবাজ তরুণীর কথা। ভাটির এই অবহেলিত প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে ওঠেছে মেয়েদের ফুটবল ক্লাব। সামাজিক নানা বাঁধা-বিপত্তি মাড়িয়ে ক্লাবটিতে এখন ৮০ জনের মতো কিশোরী ফুটবল খেলছে। প্রতিদিন যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রত্যন্ত এলাকার হাওরগুলোতে নৌকায় ভেসে পাড়ি দিয়ে এক হয় দিরাই উপজেলার স্টেডিয়ামটিতে। রোদ-বৃষ্টি যাইহোক, সবকিছু মাড়িয়ে করতে থাকে ফুটবলের কঠোর অনুশীলন।  

সামাজিকতা আর রক্ষণশীলতার দোহাই দিয়ে মেয়েদের ঘরে আটকে রাখার দিনটা যে ফুরিয়ে গেছে, তারই উদাহরণ, হাওর পাড়ের এইসব মেয়েরা। স্বপ্নচোড়ার ডাকে সাড়া দিয়ে ভাটির মেয়েরা আজ ছুটে চলছে সফলতার সোনালি মঞ্চের দিকে। একসময় কোণঠাসা করে রাখা আত্মীয় কিংবা পাড়া প্রতিবেশীরাও এখন তাদের দিয়ে যাচ্ছেন এগিয়ে যাওয়ার একবুক সাহস। লিজারা আজ কারো বোঝা নয়, অনেকের কাছেই অহংকারের পাত্র। যার নেপথ্যে কাজ করছে স্বপ্নচূড়ার সাহসী এক যুবক৷ 

রাকিব আহমেদ। ভাটির দেশ দিরাইয়ের ভাটিপাড়া গ্রামে জন্ম নেওয়া রাকিবের স্বপ্ন ছিল ভালো মানের একজন ফুটবলার হবেন। খেলবেন জাতীয় দলের একজন খেলোয়াড় হিসেবে। নিজের স্বপ্নের সঙ্গে পূরণ করবেন দেশেরও স্বপ্ন। কিন্তু ইনজুরি আর নানা জটিলতার বেড়াজালে আটকে যায় রাকিবের সেই রঙিন স্বপ্ন।

কিন্তু অদম্য রাকিব থেমে যাননি। চকচকে শহর ছেড়ে চলে আসেন হাওর পাড়ের অবহেলিত জনপদে। পিছিয়ে পড়া ভাটির মেয়েদের দিয়েই নিজের স্বপ্নকে পূর্ণ করার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গড়ে তোলেন স্বপ্নচূড়া নামে একটি ব্যতিক্রমী ফুটবল ক্লাব। যেখানে শুধু মেয়েদের নিয়ে কাজ করা হবে। 

একে তো রক্ষণশীল একটি এলাকা, যেখানে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিকতার দোহাই দিয়ে মেয়েদের ঘর থেকে বের হতেই দেওয়া হয় না। তার ওপর গ্রাম্য সব কোণঠাসার রাজনীতি তো আছেই।এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মেয়েদের মাঠে এসে ফুটবল খেলা তো কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। রক্ষণশীল এলাকাটিতে একটা সময় যেগুলো ভাবাই যেত না, সেই ভাবনাগুলো আজ বাস্তব হয়েছে। 

রাকিব বলেন, ‘রক্ষণশীল এলাকা তো, যেকারণে  প্রথম দিকে অনেক বাঁধা-বিপত্তি পোহাতে হচ্ছে। তারপরও দমে যাইনি। শুরু করি কাজ। গ্রামে গ্রামে গিয়ে অভিভাবকদের বুঝাতে থাকি। একটা সময়, মানুষের ধারণা পাল্টাতে শুরু করে। মেয়েরা আসতে থাকে ফুটবল ক্লাবে। মাত্র ৯ জন মেয়ে নিয়ে শুরু করি, এখন আমার স্বপ্নচূড়ায় শতাধিক মেয়ে ফুটবল খেলে।’ 

নিয়মিত অনুশীলন করা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে ফুটবল খেলতে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে অনেক টাকার দরকার হয় জানিয়ে রাকিব বলেন, ‘মাঝেমধ্যে দু’একজন প্রবাসী ও হৃদয়বান কিছু ব্যক্তির অনুদানে কোনোরকম চলে। স্বপ্নচূড়ার মেয়েদের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করতে সমাজের বিত্তশালীসহ সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।’ 

২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ক্লাবটি এরই মধ্যে নিজেদের জানান দিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত। ক্লাবের কিশোরীরা দেশের বিভিন্ন জেলায় ও উপজেলায় সাহসিকতার সঙ্গে নিয়মিত খেলে যাচ্ছে। ছিনিয়ে নিয়ে আসছে একেরপর এক গৌরবগাঁথা বিজয়।

প্রতিষ্ঠার এক বছরের মধ্যেই ‘আয়েশা, পূর্ণিমা, পলি, একা, মৌ ও জুবলী বেগম’ নামে ক্লাবটির ছয় কিশোরী দেশের জাতীয় ফুটবল লিগে অংশ নিয়েছে। এবছরের প্রথমদিকে বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল প্রিমিয়ার লিগে অংশ নেওয়ার জন্য সপ্তম দল হিসেবেও তালিকাভুক্ত হয়েছিল স্বপ্নচূড়া।

শুধু তাই নয়, স্বপ্নচূড়া এফসির মেয়েদের ফুটবলের আওয়াজ পৌঁছে গেছে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনেও। গত কিছু দিন আগে বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্ছ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফার নজরে আশে স্বপ্নচূড়ার নৈপূণ্যের কথা। এ নিয়ে ফিফার অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্ট (ফিফা উইমেন্স ওয়ার্ল্ড কাপ) থেকে একটি পোস্ট করা হয়। একটি ভিডিওর পাশাপাশি ফিফা লেখে ‘এ গ্রহে ফুটবল হচ্ছে বৈশ্বিক ভাষা। বৃষ্টির মৌসুমে বিভিন্ন  কারণে প্রায়ই সমস্যা দেখা দেয়। এই মেয়েরা (স্বপ্নচূড়া) প্রায়ই সমালোচনার শিকার হয়। কিন্তু তারা লক্ষ্যে অবিচল। ৬ কিলোমিটার দূর থেকে নৌকায় এসে অনুশীলন করে ওরা’।  বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থার এমন অনুপ্রেরণামূলক সাড়ায় ব্যাপক আনন্দিত স্বপ্নচূড়ার মেয়েরা।

স্বপ্নচূড়ার প্রতিষ্ঠাতা রাকিব আহমেদ বলেন, ‘অবহেলিত একটা অঞ্চলে গড়ে ওঠা মেয়েদের ফুটবল দলটি ফিফার নজর কাড়বে ভাবতেই পারিনি। সত্যিই অনেক ভালো লাগছে। একদিন এই মেয়েরা দেশের হয়ে ফিফার ওয়ার্ল্ড কাপে খেলবে ও এই কিশোরীরাই একদিন বিশ্ব জয়ের হাসিতে মাতবে, এটাই প্রত্যাশা। ’

লেখক: শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, এমসি কলেজ। 

সিলেট/মাহি