ক্যাম্পাস

শিক্ষার মানোন্নয়ন কেন জরুরি? 

যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত হবে, সে জাতি তত বেশি উন্নত হবে। শিক্ষার মান বজায় রাখা একটি দেশের জন্য জরুরি। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য শিক্ষা দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাই শিক্ষাব্যবস্থাকে যথাযথ কাঠামোর মধ্যে রাখতে হবে। দেশ কত উন্নত হবে অথবা রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কতটুকু উন্নয়নের পথে ধাবিত হবে, তা বোঝা যায় শিক্ষাসংক্রান্ত পরিকল্পনার ভেতর দিয়ে। 

শিক্ষা ও শিক্ষার মান কথা দুটির ভিন্ন তাৎপর্য রয়েছে। শিক্ষা বলতে শুধু শিক্ষিত জাতি গঠন কিন্তু দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করতে হলে শিক্ষার মান নিশ্চিত প্রয়োজন। বর্তমানে বহুল উচ্চারিত শব্দ হলো ‘মানসম্মত ও গুণগত শিক্ষা’। শিক্ষা দেওয়া ও গ্রহণ করার সাধারণ রীতি যেটা শিক্ষিত খেতাবের জন্য, কিন্তু একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে গেলে প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষা। তাই শিক্ষার মান উন্নয়ন প্রয়োজন। যদি শিক্ষার মান উন্নয়ন করা যায়, তাহলে দেশের উন্নয়নও দ্রুত গতিতে হবে। 

আমাদের বর্তমান শিক্ষার প্রেক্ষাপট কী? শিক্ষার গুণগত মান কতটা বজায় থাকছে? প্রশ্নগুলোর যৌক্তিকতা আছে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন এবং প্রতিটি নাগরিকের শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য ব্যাপক প্রয়াস চালানো হচ্ছে। তবে কোথাও যেন এই প্রশ্নগুলো থেকেই যাচ্ছে সবার মনে। শিক্ষাকে সবার কাছে পৌঁছে দেওবার চেষ্টা করা হলেও অনেক ছেলে-মেয়ে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। প্রাথমিক স্তরে এসব ছেলে মেয়ের অংশগ্রহণ লক্ষ করা গেলেও মাধ্যমিক স্তর শেষ হওয়ার আগেই এরা লেখাপড়ায় ইতি টেনে দেয়। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নেমে বিভিন্ন জীবিকার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।  অনেকে আবার শিক্ষার গণ্ডি পেরিয়ে ও চাকরির অপেক্ষায় বসে থাকে, ফলে বেকারত্ব নামক শব্দটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

শিক্ষার গুণগতমান যদি ঠিক থাকে, তাহলে সেই শিক্ষাকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী নিজেদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে নিতে পারবে। 

মানসম্মত শিক্ষা পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রত্যাশার আলোকে গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে মানসম্মত শিক্ষা বলতে ওই ধরনের শিক্ষা কর্মসূচিকে বোঝানো হয়েছে, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা অর্জিত জ্ঞান বাস্তবতার নিরিখে কাজে লাগিয়ে ঊর্ধ্বমুখী জীবনযাপন ও অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ লাভ করতে পারে। বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কেননা এটি শিক্ষার গুণগত মান ঠিক রাখে ও শিক্ষাব্যবস্থায় প্রগতিশীলতা আনে। 

 বর্তমান শিক্ষায় মেধা যাচাইয়ের জন্য চালু রয়েছে সৃজনশীল প্রশ্ন। ‘সৃজনশীল’ শব্দটা শুনলে মনে হয় শিক্ষাব্যবস্থায় কঠিন কিছু যুক্ত হয়েছে কিন্তু আসলে শিক্ষার্থীরা এটাকে খুব সহজে গ্রহণ করছে। কেননা এই সৃজনশীল পদ্ধতিতে জিপিএ-৫ এর পরিমাণ বেড়েছে। চিন্তাশীলতার বিকাশের কথা চিন্তা করেই সৃজনশীল ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, তাই এটার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কতটা সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটছে, তা শিক্ষকের যাচাই করা জরুরি। এক্ষেত্রে পরিমাপের পদ্ধতি নির্ভুল রাখতে হবে। 

তবে এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় হলো শিক্ষকের দক্ষতা। শিক্ষক জাতি গঠনের কারিগর। শিক্ষার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এজন্য শিক্ষককে যথাযথ প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হতে হবে। শিক্ষক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটগুলোতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে সুদৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষককে হতে হবে নৈতিক চরিত্রের অধিকারী, নিরপেক্ষ, অকুতোভয় ও সত্যবাদী। 

সমকালীন চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে প্রথাগত শিক্ষার চেয়ে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব বেশি, তাই শিক্ষাকে কারিগরি শিক্ষার দিকে চালিত করা জরুরি। ২০৩০ এর মধ্যে মানসম্মত ও সার্বজনীন মাধ্যমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্য SDG-৪ এ উল্লেখ আছে।  যত দ্রুত সম্ভব উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করা জরুরি। শিক্ষার গুণগত মানের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করে কতটুকু উপকৃত হচ্ছে, তা দেখা জরুরি এবং শুধু জিপিএ-৫ ও পাসের হার বৃদ্ধি করা নয়, শিক্ষার্থীরা কতটুকু কার্যকরী জ্ঞান অর্জন করতে পারছে, সেটাই মুখ্য বিষয়। বর্তমানে আমাদের অভিভাবকরা জিপিএ-৫ কে বেশি গুরুত্ব দেয়, তাদের সন্তানরা জিপিএ-৫ পেয়েছে কিনা এটাতে তাদের বেশি মাথা ব্যথা। কিন্তু আসলে প্রকৃত শিক্ষা বলতে কতটুকু অর্জন করতে পারছে, সেটা নিয়ে কোনো চিন্তা নেই।  অভিভাবকসহ সবার উচিত শিক্ষার্থীরা স্তরভিত্তিক যোগ্যতা কতটুকু অর্জন করতে পারছে, তা অনুধাবন করা।

নামে মাত্র পাস আর ডিগ্রি সার্টিফিকেট নিয়ে শিক্ষিত বেকার তৈরি হয়, শিক্ষিত জাতি নয়। তাই এই বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত।  যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার চাহিদার পরিবর্তন হতে থাকে। বর্তমান যেহেতু তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর যুগ, তাই শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্প্রসারণশীল হলেও শিক্ষার গুণগত মানের ক্রমাগত অবনতি লক্ষ করা যায়। 

শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের গভীরতা কতটুকু হচ্ছে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। নকল প্রবণতা বর্তমানে বহুল আলোচিত বিষয়। এছাড়া পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, সার্টিফিকেট জালিয়াতি করার মতো খারাপ কাজও করা হয়, এগুলো শিক্ষাকে একটা ব্যবসায় পরিণত করছে।

সাধারণত শিক্ষাকে আমরা তিন স্তরে ভাগ করি। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা। এই তিন স্তরের মধ্যে বিভাজনও বহুবিধ। প্রাথমিক স্তরে প্রধানত তিন ধরনের বিভাজন পাওয়া যায়। সাধারণ সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের স্কুল, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল আর মাদ্রাসা শিক্ষা। এইসবের মধ্যেও আবার নানা ধরনের বিভাজন রয়েছে। তবে মূল বিভাজনটি হচ্ছে পাঠ্যসূচিতে, যেটি কখনো কাম্য নয়। 

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার মান যথাযথ রাখাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ করা হয়। কিন্তু অনেক সময় ক্লাসের সংখ্যা এত বেশি হয় যে, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমন কোনো ভালো মানের গবেষণা হয় না। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য খুব বেশি বরাদ্দ না থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন হতে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় গবেষণার জন্য ভালো বরাদ্দ পাওয়া যায়। তবে এইসব বরাদ্দ কতটা গবেষণায় ব্যয় হয় তা সন্দেহ রয়েছে। 

এখনই সময় শিক্ষার মান উন্নয়নের দিকে দৃষ্টিপাত করা আর শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য সর্বপ্রথম যে বিষয়টি দরকার, তা হলো সুষ্ঠু পরিকল্পনা। শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য যা প্রয়োজন, তা যথাসময়ে সম্পন্ন করতে হবে। শিক্ষার মান বজায় রাখতে কোচিং সেন্টারকে প্রাধান্য না দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এর উপযোগী করে তুলতে হবে।

এগুলো ছাড়াও শিক্ষাক্ষেত্রে আরো একটি বড় অন্তরায় হলো নকল, প্রশ্ন ফাঁস ও দুর্নীতি। তাই এগুলোকে শক্ত হাতে বন্ধ করতে হবে। শিক্ষক এবং অভিভাবকদের মধ্যে নৈতিক বোধ জাগ্রত করা খুবই প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় প্রথম হওয়া বা খুব ভালো ফলাফল করা, এমন অসুস্থ প্রতিযোগিতাকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। তাদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। যেন তারা শিক্ষার আসল তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারে।

শিক্ষার মান উন্নয়নে শুধু সরকার নয়, নাগরিক হিসেবে অভিভাবকদেরও কিছু দায়িত্ব কর্তব্য রয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দেওয়া অভিভাবকদের অন্যতম দায়িত্ব। সন্তানের যতটুকু মেধা, দক্ষতা আছে, সে ততটুকু নিয়েই শিক্ষা গ্রহণ করবে।

একজন শিক্ষকই পারে শিক্ষার্থীকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে, তাই শিক্ষককে নিরপেক্ষ হয়ে মূল্যায়ন করতে হবে। উত্তম শিক্ষার জন্য প্রয়োজন অনুকূল পরিবেশ। তাই শিক্ষার মান উন্নয়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মানসম্মত ও গুণগত মানের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।