ক্যাম্পাস

প্রমিত বাংলা ভুলে যাচ্ছেন তরুণরা

হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নির্ভর বাংলা একটি সমৃদ্ধ ভাষা। পৃথিবী রবে যতদিন, বাংলা ভাষাও রবে তত দিন। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। বছর ঘুরে ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি সেই ভাষা-সংগ্রামীদের, যাদের বুকের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঢাকার পিচঢালা রাজপথ। 

‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’-এ আন্দোলন শুধু ভাষার জন্য আন্দোলন ছিল না, ছিল প্রতিটি বাঙালির অস্তিত্বের আন্দোলন। ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির কাছে আত্মত্যাগ, শ্রদ্ধা ও অহংকারের মাস। বাঙালি জাতির কাছে বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে প্রেরণার মাস ফেব্রুয়ারি। মহান এ ভাষার মাসে বাংলা ভাষাকে নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন তরুণ শিক্ষার্থীর ভাবনা, মতামত ও প্রত্যাশা তুলে ধরেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ।

বাংলা ভাষা চর্চায় অনীহা নয়

নিগার সুলতানা সুপ্তি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, দীর্ঘ সংগ্রামের ফলে বাংলা ভাষা বিশ্বে একটি দুর্লভ মর্যাদা পেলেও বর্তমানে বাংলা ভাষায় চলছে অবাধ বিকৃতি। নিজেদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়া সন্তানটি বাংলায় কথা বলতে জানে না কিন্তু এটাই যেন মা-বাবার জন্য গর্বের হয়ে উঠে। 

আমাদের নবীন প্রজন্মের মুখে আজ উচ্চারিত হয় ইংরেজি, হিন্দি মেশানো এক জগাখিচুড়ি বাংলা ভাষা। দিনকে দিন প্রমিত বাংলা ভুলে যাচ্ছেন তরুণরা। বাংলা নাটক, সিনামার চেয়ে হিন্দি, কোরিয়ান তাদের কাছে পছন্দের শীর্ষে। আনিসুল হকের মা না চিনলেও ম্যাক্সিম গোর্কির মা চিনতেই হবে। আবার ভাষার মাস আসলেই ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধসম’ প্রবচনটি উচ্চারিত হয়। এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। অপ্রয়োজনে ভিনদেশি ভাষা ও সংস্কৃতি ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। শুদ্ধ বাংলা ভাষার প্রয়োগ ঘটাতে হবে। নতুন প্রজন্মকে ভাষার অপব্যবহার না করে জাতীয় জীবনে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান ও সাংবিধানিক বাস্তবায়ন করতে হবে।

বাংলা ভাষা আমাদের গর্ব

আসিক আদনান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, বাঙালি জাতি হিসেবে গর্ব করার মতো অনেক কিছুর মধ্যে একটি হচ্ছে আমাদের ভাষা। পৃথিবীতে এটিই একমাত্র ভাষা, যে ভাষায় কথা বলার জন্য রক্ত দিতে হয়েছে। ভাষার জন্য পৃথিবীর আর কোথাও কেউ জীবন দেয়নি, করেনি মরণ পণ সংগ্রাম। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন ১৯৪৭-এ শুরু হয়েছিল, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এসে তা পূর্ণতা পায়। 

মাতৃভাষার সঙ্গে মানুষের সখ্যতা ও পথচলার ব্যাপ্তি পুরো জীবন পর্যন্ত। শৈশবের সেই আধো বোল থেকে শুরু করে পৌঢ়তা ও বার্ধক্য পর্যন্ত এই মাতৃভাষাই আমাদের মনের ভাব অন্যকে জানানোর প্রধান সম্বল। বাংলা ভাষা আমাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে এক সূত্রে গাঁথতে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে এবং সর্বোপরি বাংলাদেশ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। আমি গর্বিত বাঙালি হিসেবে; একজন বাংলাভাষী হিসেবে আমার ভাষাই আমার গর্ব।

ভাষার মর্যাদা অটুট থাকুক সর্বস্তরে

শাহিন হোসেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি, বাঙালির জাতীয় জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বে বাঙালিই একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য জীবনকে উৎসর্গ করেছে অকাতরে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলা ভাষার মর্যাদাকে আমরা কতটুকু রক্ষা করছি? বাঙালির ভাষা, ঐতিহ্য, বিনোদন ও সংস্কৃতি যেমন গান, নাটক, সিনেমা ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিদেশি ভাষার মিশ্রণ ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়। 

হিন্দি, ইংরেজির মিশ্রণ এছাড়াও সর্বস্তরে রয়েছে শুদ্ধতার অভাব। বাংলা ভাষার মর্যাদাকে রক্ষা করা প্রতিটি বাঙালির অন্যতম দায়িত্ব। তাই, আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে চাই বাংলা ভাষার কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা ও শুদ্ধ প্রয়োগ। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি হোক বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা ও শুদ্ধতা চর্চার একমাত্র অঙ্গীকার।

ভাষা হোক উন্মুক্ত, হোক প্রতিবাদের ধ্বনি

সিনথিয়া সুমি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ভাষার প্রতি কতটা আবেগ ও ভারোবাসা থাকলে নিজের শরীরের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে ছিনিয়ে আনতে পারে তার প্রমাণ বায়ান্নর ভাষা শহীদরা। আমাদের দেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ভাষা সচেতনতার অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। নতুন প্রজন্ম বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি সব ভাষা একত্রে বলছে ও লিখছে, কোনো ভাষাতেই সুনির্দিষ্টভাবে নিজেদের মেলে ধরতে পারছে না। 

বাংলা ভাষার ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য সবার প্রতি সচেতনতা তৈরির বিকল্প কিছু হতে পারে না। একুশের চেতনায়, ভাষা আন্দোলনের মহিমায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে আমাদের নতুন প্রজন্মকে। আমরা মাতৃভাষা ছিনিয়ে আনতে পারলেও এখনো সম্পূর্ণ মর্যাদা দিতে পারিনি। ভাষার মাসে একটাই প্রত্যাশা, মাতৃভাষাকে যথার্থ সম্মান দিয়ে বিশ্বের বুকে বাংলা ভাষাকে আরো সমৃদ্ধ করতে হবে। তাই আমাদের উচিত মাতৃভাষা বাংলাকে শ্রদ্ধা করা এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা।

জৌলুস হারাচ্ছে বাংলা ভাষা

তাহমীদ হাসান শোভন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’ অ্যান্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী।  তিনি বলেন, দেখতে দেখতে বছর ঘুরে এলো ভাষার মাস। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির তাজা রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি ‘মাতৃভাষা’ বলে এক মূল্যবান উপহার। কিন্তু সেই বাংলা ভাষার আজ বেহাল দশা। অবহেলায় জর্জরিত হচ্ছে দিনকে দিন। বর্তমান উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের মুখে ফুটে মিশ্র ভাষা অর্থাৎ বাংলা, ইংরেজি, হিন্দিসহ অন্যান্য ভাষার মিশ্রণ। যা বাংলার প্রতি একটু একটু অবহেলার চরম পরিণতি। 

পাশাপাশি বর্তমানে ভালো চাকরির জন্য ইংরেজির বিকল্প না থাকায় তরুণরা সেদিকে গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি। ফলে, পরোক্ষভাবে বাংলা হারাচ্ছে তার জৌলুস। এমতাবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস, আদালত থেকে শুরু করে যেসব কর্মসংস্থানে ইংরেজির প্রচলন বেশি, সেখানে বাংলার ব্যবহার আরো বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ সময়ের দাবি।

সব আঞ্চলিক ভাষাকে রক্ষা করি

রেজওয়ান আহম্মেদ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ডিসিপ্লিনের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, বাংলা ভাষার একটা বড় বৈশিষ্ট্যই হলো বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন রকম আঞ্চলিক ভাষার প্রচলন। যাদের রয়েছে নিজস্ব শব্দকোষ ও রীতি। যা বাংলা ভাষাকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শব্দ দিয়ে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করছে। শুধু কথায় নয়, প্রাচীন যুগ থেকে আঞ্চলিক ভাষা কবিতা, গান, সাহিত্য বা নাটকের সংলাপে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু বর্তমানে দেখা যায়, অনেকেই আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ তো করেনই না, বরং হীনমন্যতায় ভোগেন। 

আমাদের মনে রাখা উচিত, আঞ্চলিকতা মানে সংকীর্ণতা নয়, এটা আমাদের ঐতিহ্য। তাই ভাষার এই বৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের ব্যক্তি, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের প্রত্যেককে এগিয়ে আসতে হবে।

সর্বস্তরে হোক বাংলা ভাষার প্রচলন

খন্দকার নাঈমা আক্তার নুন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, বাঙালি জাতির দিন বদলের সূচনা হয়েছিল শহীদ সালাম, বরকত, জব্বারদের হাত ধরেই। বাঙালিই ইতিহাসের প্রথম জাতি, যারা ভাষার জন্য আন্দোলন করেছে, জীবন দিয়েছে। আজ সেই বাংলা ভাষাকে আমরা ভুলতে বসেছি। কথায় কথায় বাংলার সাথে ইংরেজির মিশ্রণ ঘটাচ্ছি। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ইংরেজি শেখাতে জোর দিচ্ছেন। দেশে গড়ে উঠা ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষায় নাকি কথা বলতে জানে না, বাংলা বলতে নাকি তাদের কষ্ট হয়; যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। 

আমাদের সন্তানদের এ অভ্যাস থেকে বের করে বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জন্ম দিতে হবে। চিঠি-আমন্ত্রণপত্র, তরুণ প্রজন্মের ক্ষুদে বার্তাসহ সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রতি জোর দিতে হবে। শুদ্ধ বাংলা ভাষা চর্চা ও বাংলার ঐতিহ্য রক্ষায় সচেতনতামূলক কাজ করতে হবে এবং বাংলা ভাষার ব্যবহার সর্বত্র নিশ্চিত করতে হবে। ভাষার মাসে শপথ হোক শুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চা ও বাংলা ভাষার প্রচলন।

ভাষাকে দূষণ ও বিকৃতি থেকে বাঁচাতে হবে

রাজু আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। যে মাতৃভাষার আন্দোলনে নিহিত ছিল আমাদের স্বাধীনতার বীজ। মাতৃভাষার জন্য রক্ত দিয়েছিল আমাদের ভাই রফিক, জব্বার, সালাম, ররকত কিন্তু আমরা কি সেই মর্যাদা সমুন্নত রাখতে আন্তরিকতার পরিচয় দিতে পেরেছি? বরং নানাভাবে ভাষাকে দূষণ করেছি, করছি ভাষা বিকৃতি। 

বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিশ্রণ করে কথা বলা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অন্য দিকে গণমাধ্যমে মাতৃভাষা ব্যবহারে অসতর্কতা লক্ষণীয়, ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে যাচ্ছে ভুল বার্তা। মাতৃভাষা বাংলা চর্চা সর্বত দূষণ মুক্ত হোক। ভাষার মাসে এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।