ক্যাম্পাস

তরুণ লেখকদের ভাবনায় বাংলা ভাষা 

বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে বাংলা ভাষা অত্যন্ত প্রিয় ও আবেগের। কারণ, বাঙালিই প্রথম ও একমাত্র জাতি, যারা কিনা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল। সেই নির্মম ও সাহসী ঘটনা আমাদের সবারই জানা। 

বাংলা ভাষার মতোই ২১ ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বাঙালির কাছে অত্যন্ত আবেগঘন একটি দিন। কারো কাছে আনন্দের, কারো কাছে আত্মত্যাগের উপহার, কারো কাছে আবার দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার উৎসাহ ও নতুন বিজয়ের সূচনা। নানাজনের নানা মত। তবে বর্তমান তরুণ প্রজন্মের লেখকরা ভাষা দিবসকে নিয়ে কী ভাবছেন, তাদের অভিমত জানাচ্ছেন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক দিবারুল ইসলাম দ্বীপ। 

নাহিদ আহসান, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজিতে তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত আছেন। তার সম্প্রতি প্রকাশিত বই ‘মায়ের নীল শাড়ি’ গল্পগ্রন্থ। তিনি বলেন, বাংলা আমার অহঙ্কার-এই কথাটি সবাই সবসময় বলে উঠে না, হয়তো সাহসের অভাবে কিংবা বন্ধুদের দ্বারা তথাকথিত ‘স্মার্ট’ উপাধি থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে। ফেব্রুয়ারি এলেই সবার মনে একটু সাহসের সঞ্চার হয় এবং আমরা বলে উঠি এই ভাষা আমার অহঙ্কার।  যদিও বাকি ১১ মাস ভুলে থাকি, তবুও বুক উঁচু করে বলে ফিরি, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’ 

হাসান মাহমুদ, মুন্সিগঞ্জের সরকারি হরগঙ্গা কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে (অনার্স) তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত আছেন। তার সম্প্রতি প্রকাশিত বই ‘ছন্দময় জীবন’। তিনি বলেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেখা যায়, নতুন দেশের ডাকটিকিট, মুদ্রা, মানি-অর্ডার বা টাকা পাঠানোর ফর্ম, ট্রেনের টিকেট, পোস্টকার্ড-এগুলোতে শুধু উর্দু ও ইংরেজি ব্যবহৃত হচ্ছে। এর প্রতিবাদে ঢাকায় ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা বিক্ষোভ সমাবেশও করেছিল। কিন্তু আজও এগুলোতে বিদেশি ভাষা ব্যবহার হয়। যা বাঙালি হিসেবে আমাদের মোটেও কাম্য নয়। 

এসব ক্ষেত্র থেকে বিদেশি ভাষা দূর করতে হবে। ভাষা দিবস শুধু আমাদের ২১ ফেব্রুয়ারি আসলেই মনে পড়ে আর সারাবছর কোনো খবর থাকে না। এটি এক দিনের নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সবখানে আমাদের নিজেদের বাংলা ভাষার প্রতি যত্নশীল হতে হবে। বিশ্ব দরবারে বাংলাকে উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করতে হবে।   

মালিহা তাবাসসুম, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজে অধ্যয়নরত একজন এমবিবিএস শিক্ষার্থী। তার সম্প্রতি প্রকাশিত ফরেনসিক থ্রিলার বই ‘ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স’। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এলেই আমাদের প্রত্যেকের মুখে দু’কলি গান শোনা যায়, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’ এই গানটির সুরকার আলতাফ মাহমুদ আমার আত্মীয় হওয়ায় ছোটবেলায় গানটা শুনলে গর্ব হতো ঠিকই কিন্তু শিহরণ হবার পরিপক্কতা ছিল না৷ বহমান কালের স্রোতে সাঁতার করতে করতে ‘মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া’-বাঙালি জাতির এই অসমসাহসিকতা আমার রক্ত ধারায় শিহরণ জাগায়৷ আচ্ছা, চিরায়ত বিবর্তনের হাত ধরে আসা বাংলা ভাষা কি কেবলই এক ভাষা? না! বাংলা কাঁটাবনে বইয়ের স্তুপের নিচে পড়ে থাকা কোনো কিশোর প্রেমিকের প্রেমপত্রের শতরঞ্চ! প্রেসক্লাবের সামনে প্ল্যাকার্ড হাতে বাবার মৃত্যুর বিচার চেয়ে দাঁড়ান মেয়েটির দুঃখবিলাসই বাংলা! 

বাংলা মানে নজরুলের বিদ্রোহ, বাংলা মানে জীবনানন্দের নৈঃসঙ্গ বিলাস, সত্যজিতের বহুমাত্রিকতা, রবীন্দ্রনাথের বৈশ্বিক স্বীকৃতি! আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারির স্বীকৃতি বিশ্বের দরবারে আমাদের সম্মান সমুন্নত করেছে৷ তবু তরুণ প্রজন্মের অনেকের প্রতি জ্যেষ্ঠদের অভিযোগ, বাংলাকে আমরা তরুণরা ভালোবাসি না, কথায় কথায় ইংরেজি শব্দের মিশেলে বাংলাকে ঠাট্টার পাত্র করা হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি! তবে বিশ্বাস করুন, হয়তো বিশ্বায়নের প্রভাবে ইংরেজি শব্দের বা বাক্যের অনুপ্রবেশ দৃষ্টিকটু হলেও সব তরুণকে একই দাড়িপাল্লায় ওজন করবেন না৷ 

যে জাতি ভাষার জন্য রক্ত দিতে পারে, তার উত্তরসূরি কখনো বাংলা নামের বটবৃক্ষের শিকড়কে মরে যেতে দেবে না। বাংলা ভাষা বেঁচে থাকবে যুগ যুগান্তর, এ যে রক্তের ঋণ। হয়তো ভিন্ন মোড়কে কিন্তু তবু বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ পাবে সত্যজিতের মতো নতুন কোন অস্কার বিজয়ীকে, রবীন্দ্রনাথের মতো নতুন কোনো নোবেল বিজয়ীকে।

সৌরভী আলম আখি, বর্তমানে ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজে চতুর্থ বর্ষে পড়াশোনা করছেন। তার সম্প্রতি প্রকাশিত বই ‘অশ্রুমতি’ উপন্যাস। তিনি বলেন, মাতৃভাষা এবং মাতৃভাষা দিবস। আমাদের এই বঙ্গদেশে এই দুইয়েরই বিস্তৃত ইতিহাস রয়েছে। প্রথমেই আসি আমাদের মাতৃভাষা তথা বাংলা ভাষায়। আমাদের এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত চলতে থাকে। তারপর ভাষা আন্দোলন। 

সেই ২১ আমাদের গর্ব। একুশের মধ্যে আমাদের যে আবেগ রয়েছে, তা আমাদের শক্তি। তবে আফসোসের বিষয়, এত রক্তের বিনিময়ে পাওয়া বাংলা ভাষার ব্যবহার ও চর্চায় আমাদের তরুণ প্রজন্ম এখনো অসচেতন। এদের মাঝে বিদেশি ভাষায় কথা বলার চর্চা বাড়ছে। ইংরেজি বলতেই স্মার্টনেস বোঝে আমাদের তরুণরা। এসব চিন্তা-ভাবনার কারণে আমাদের মাতৃভাষা তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে। এদিকে আমাদের সবার সোচ্চার হতে হবে। রাষ্ট্রীয় কাজে মাতৃভাষার ব্যবহার বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে-

‘একুশ আমাদের প্রাণ, একুশ করেছে দান একুশ মোদের পাথেয়, একুশকে করো নাকো হেয়।’

শাহরিয়ার জাওয়াদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। সম্প্রতি তার প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির বই ‘গ্রাফিতিরা জেগে রয়’। তিনি বলেন, ভাষা একজন মানুষের আত্মপ্রকাশের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। ভাষার মাধ্যমেই আমরা নিজেদের চারপাশের মানুষের কাছে প্রকাশ করতে পারি। খুব সহজে, সাবলীলভাবে। 

মানুষ তিনটি বিষয়কে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। মা, মাতৃভূমি এবং মাতৃভাষা। মাতৃভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করে যে প্রশান্তি সেটা পৃথিবীর আর কোনো ভাষাতেই পাওয়া যায় না। আমরা যারা বাংলা ভাষায় লিখছি, লেখার চেষ্টা করছি, মাঝে মাঝে ভাবি, আমরা কত ভাগ্যবান! আমরা নিজের ভাষায় যেমন খুশি তেমনভাবে লিখে যেতে পারছি। গল্প বলতে পারছি। আমরা নিজেদের কর্মব্যস্ততায় ডুবে থাকি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, বছরের এই একটা দিন আমাদের এই কর্মব্যস্ত জীবনের মাঝেও মনে করিয়ে দিয়ে যায় যে, আমাদের মুখের ভাষা কতটা প্রাপ্তির, কতটা প্রশান্তির, কতটা সম্মানের। 

মনসুর মিয়াজী মালয়েশিয়ার মাসা ইউনিভার্সিটির ফাউন্ডেশন ইন সায়েন্স কোর্সে অধ্যয়নরত আছেন। তার সম্প্রতি প্রকাশিত বই ‘গৃহবন্দীর গল্প’ গল্পগ্রন্থ। তিনি বলেন, যেকোনো জাতির সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যম ভাষা। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বাহনও ভাষা। আমার মাতৃভাষা আমার জীবনের অংশ, অস্তিত্বের স্মারক। জননী যেমন তাঁর সন্তানকে আগলে রেখে বড় করে তোলেন, ভাষাও তেমনি মাতৃসম স্নেহে সাহিত্য সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে বুকে ধরে সমৃদ্ধ করে তোলে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির নেই যে, ভাষার জন্য এত মানুষ জীবন দিয়েছে। এত রক্তের বিনিময়ে পাওয়া বাংলা ভাষার ব্যবহার ও চর্চা সম্পর্কে এখনো এ দেশের মানুষ সচেতন নয়।  শুধু মূল্যবোধের অভাবে বাংলা ভাষা তার নিজস্বতা হারাচ্ছে। ভাষা আন্দোলনের মূল দাবি ছিল- সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন ঘটানো। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আজও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি। 

এখনো ঢাকা শহরের নব্বই ভাগ প্রতিষ্ঠানের নামফলকগুলো লেখা হয়ে থাকে ইংরেজিতে। রাজধানীর সামান্য কয়টি নামফলকেও যেখানে এখনো বাংলা ভাষা স্থান পায়নি, সেখানে শুধু ভাষা দিবস এলে লোকদেখানো এতসব আনুষ্ঠানিকতার কোনো মানে হয় না। এর বদলে সর্বস্তরে যাতে বাংলা ভাষার মর্যাদা সর্বদা—১২ মাস তথা ৩৬৫ দিনই উচ্চ স্থানে থাকে, সেদিকে নজর রাখাটা বেশি জরুরি।