ক্যাম্পাস

বডি বিল্ডিংয়ে দুঃসাহসী এক নারী 

ফাতেমা সুলতানা। তিনি ৭ বছর বয়সী কন্যা সন্তানের মা। এক সময় তার শারীরিক ওজন ছিল ৭৫ কেজি। অনেকটা স্তুলাকায় বলতে যা বোঝায়, ঠিক তেমনই। কিন্ত মাত্র তিন বছরের কঠোর পরিশ্রমে নিজেকে তৈরি করেছেন একজন অনুকরণীয় মডেল হিসেবে। তবে তিনি কোনো বিজ্ঞাপন চিত্রের মডেল নন। শরীর চর্চা, শরীর গঠনে তিনি একজন সত্যিকারের মডেল। 

বন্দরনগরী চট্টগ্রামে একমাত্র নারী বডি বিল্ডার। শরীর গঠনের মাধ্যমে নিজেকে তৈরি করে হেঁটেছেন আলো ঝলমলে মঞ্চের র্যাম্পেও। এখন তিনি চট্টগ্রামের বৃহৎ ফিটনেস সেন্টারের একজন মাস্টার ট্রেনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কীভাবে ফাতেমা সুলতানা একজন নারী বডি বিল্ডার হয়ে উঠলেন, গল্পটা বলেছেন রাইজিংবিডির কাছে।

আলাপকালে ফাতিমা সুলতানা বলেন, ‘‘বাচ্চা হওয়ার পর আমাদের মেয়েদের মধ্যে অনেকেরই অতিরিক্ত ওজন বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। আমার প্রথম সন্তান হওয়ার পর ওজন প্রায় ৭৫ কেজি হয়ে যায়। সেই থেকেই আমি কীভাবে এই বাড়তি ওজন কমিয়ে নিজেকে আবার ফিট রাখা যায়, তা নিয়ে ভাবতে শুরু করি। কিন্তু স্বামীর চাকরির সুবাদে আমি ফেনীতে থাকার কারণে (ফেনীতে তখন নারীদের কোনো ফিটনেস সেন্টার ছিল না) কোনো জিমে জয়েন করতে পারিনি। 

পরবর্তী সময়ে আমি চট্টগ্রামে মায়ের বাসায় মাসখানেকের জন্য বেড়াতে এসে জিমে ভর্তি হই। এখানে মাত্র কয়েকমাস জিম করেই শারীরিক ওজন ৭৫ কেজি থেকে ২৫ কেজি কমিয়ে ৫০ কেজিতে নামিয়ে আনতে সক্ষম হই। এক সময় স্বামীর বদলী সূত্রে স্থায়ীভাবে চট্টগ্রাম চলে আসি এবং জিমে শরীর চর্চাও নিয়মিত শুরু করি।

শরীর চর্চা করতে করতে এটি আমার ভালোবাসা এবং নেশা হয়ে উঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিজেকে একজন নারী বডি বিল্ডার এবং নারী ফিটনেস ট্রেইনার হিসেবে তৈরি করার মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করি।

আমি নিজে যখন জিমে ফিটনেস ট্রেইনিং গ্রহণ করি, তখন আমার সঙ্গে যারা চর্চা করেন তাদেরকেও আমি নানা স্টেপ শিখিয়ে দিতাম। একই কারণে একজন ফিটনেস ট্রেইনার হওয়ার জন্য আমার বন্ধু বা শরীর চর্চার সঙ্গীরাও আমাকে একজন ট্রেইনার হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা যোগাতো। এভাবে উৎসাহ পেয়ে আমি নিজেকে আরো দক্ষতার সঙ্গে তৈরি করার প্রস্তুতি গ্রহণ করি।’’

এরই অংশ হিসেনে আমেরিকান প্রতিষ্ঠান NESTA থেকে ‘ফিটনেস অ্যান্ড ফিগার ট্রেইনিং স্পেসালিস্ট’ বিষয়ে ১ বছর মেয়াদি একটি অনলাইন কোর্স করেন ফাতিমা সুলতানা। এরপর তিনি চট্টগ্রাম নগরীতে একজন পারসোনাল ট্রেনার হিসেবে কাজ শুরু করেন। 

২০১৮ সালে হ্যামার স্ট্রেংথ ফিটনেস সেন্টারের উদ্যোগে আয়োজিত মিস্টার অ্যান্ড মিস হ্যামার স্ট্রেংথ প্রতিযোগিতায় বেস্ট ফিগারের জন্য অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন ফাতিমা। এরপর থেকেই ফিটনেস নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা আরো বেড়ে গিয়েছিল, সেই আগ্রহ থেকেই ফিটনেসের উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

ফাতেমা সুলতানা জানান, তিনি ২০১৯ সালের শেষের দিকে চট্টগ্রামের বহুল পরিচিত ফিটনেস সেন্টার ‘আলবিরাজ জিম সেন্টারে’ ট্রেইনি হিসেবে জয়েন করেন। সেখানে জয়েন করার পর তিনি ঢাকায় আয়োজিত ‘পাওয়ারলিফটিং কম্পিটিশন সম্পর্কে জানতে পারেন এবং এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। এই প্রতিযোগিতায় বডি বিল্ডিংয়ে সারাদেশের নারী প্রতিযোগীদের মধ্যে ৫ম স্থান আধিকার করেন।

একজন নারী, একজন স্ত্রী এবং মা হিসেবে শরীর চর্চা এবং বডি বিল্ডার হিসেবে গড়ে তুলতে কোনো বাধা বা সামাজিক প্রতিবন্ধকতা কাজ করেছে কি-না, এমন প্রশ্নের উত্তেরে ফাতিমা সুলতানা বলেন, ‘এই ক্ষেত্রে আমি সত্যিকার অর্থেই দুঃসাহস দেখিয়েছি। যেহেতু রক্ষণশীল পরিবারে আমি থাকি, তাই প্রতিটি পদে পদে আমার বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছি, এখনো এই বাধার কারণে আমার স্বপ্নটাকে পুরোপুরি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারছি না। তবে এই ক্ষেত্রে আমার স্বামীর পূর্ণ সাপোর্টের কারণে আমি নিজেকে গড়তে পেরেছি। শরীর চর্চা চালিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছি।’

ফাতিমা সুলতানা নিজে একটা ফিটনেস সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে চান। যেহেতু চট্টগ্রামে এখনো মেয়েদের জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ আলাদা জিম সেন্টার নেই, তাই তিনি এটা নিয়ে কাজ করতে চান।

ফাতিমা আরো বলেন, ‘বডি বিল্ডিং কম্পিটিশনে শারীরিক মানসিক ডেডিকেশনের সঙ্গে অর্থেরও প্রয়োজন, কারণ এটা অনেকটা ব্যয়বহুল শখও বলা যায়। কোনো প্রকার স্পন্সরশিপ ছাড়া নিজের জমানো অর্থের মাধ্যমে শখ পূরণের জন্য নেমে পড়েছিলাম। বাংলাদেশে স্পন্সরশিপ ব্যবস্থা স্ট্রং হলে বডি বিল্ডিংয়ে অনেক ভালো খেলোয়াড় উঠে আসতে পারবে বলে আমি আশাবাদী।’

সাত বছর বয়সী একমাত্র কন্যা সন্তানের জননী ফাতিমা সুলতানার স্বামী একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকার। ফাতিমা বর্তমানে চট্টগ্রামের বড় ফিটনেস সেন্টার আলভিরাজ জিমের মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে কর্মরত আছেন। সব বাধা ও প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে নারীদের জন্য একটি পরিপূর্ণ ফিটনেস সেন্টার প্রতিষ্ঠার স্বপ্নটি যেনো বাস্তবে রূপ দিতে পারেন, সে জন্য তিনি সবার দোয়া প্রত্যাশা করেন।

লেখক: ব্যুরো প্রধান।