ক্যাম্পাস

বিষণ্ন মনে শিক্ষার্থীরা

করোনাভাইরাস মহামারিতে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের প্রায় এক বছর হতে চললো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে করোনার ছাপ নামেনি একটুও। দীর্ঘ এই সময়ের মধ্যে এখনো আইসোলেশনে রয়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে কুশল বিনিময়। থমকে আছে বন্ধুদের সঙ্গে ক্যাম্পাস আড্ডা। তাইতো বিষন্ন মনে প্রহর গুণছেন শিক্ষার্থীরা।

ক্যাম্পাসে সবচেয়ে বেশি হৈ-হুল্লোড়ে মেতে থাকতেন নাজমুল। পড়তেন রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজে। ক্যাম্পাসে আসলেই বন্ধুদের সঙ্গে খোশগল্প আর আড্ডায় সময় পার করতেন। তবে করোনার মধ্যে প্রায় এক বছর ধরে একাকি সময় কাটান। বন্ধুদের সঙ্গে দিতে পারেন না আড্ডা। শিক্ষকদের সঙ্গেই সশরীরে কুশল বিনিময় করতে পারছেন না। এরমাঝে অনেক রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান হলো, সেখানেও কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো না। তাই বিষন্ন মনে ঘরে বসে ঘড়ির কাটা গুণছেন, আর অপেক্ষা করছেন মহামারির ছাপ কাটিয়ে ক্যাম্পাসে যেতে। 

শুধু নাজমুল নন প্রিয় ক্যাম্পাস বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার অপেক্ষায় রয়েছেন সব শিক্ষার্থী। করোনার আগ মুহূর্তে ও করোনায় বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তিতুমীরের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা কী ভাবছেন, সেই ভাবনা তুলে ধরছেন সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী মামুনূর রহমান হৃদয়।

আফরোজা আক্তার তন্বী, রসায়ন বিভাগ 

তিনি বলেন, প্রায় বছর খানেক হয়ে গেছে ক্যাম্পাস বন্ধ। ক্যাম্পাস চলাকালীন ব্যস্ত সময়গুলো এখন বড্ড মিস করি। কলেজের সংগঠনগুলোর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকায় সারাদিন এটা-ওটা নিয়ে ব্যস্ততা থাকত। কখনো বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে বা সেমিনারে আড্ডা, কখনো বাঁধনকর্মী হিসেবে রক্তের সন্ধানে ক্লাসে ক্লাসে ছোটা, কখনো বিতার্কিক হিসেবে বিজয় বিতর্ক মঞ্চে, কখনো নাট্যদলের সদস্য হিসেবে অডিটোরিয়ামে, কখনো সাংবাদিক সমিতির সঙ্গে। বন্ধু, সিনিয়র-জুনিয়র, ক্যাম্পাসের মামাদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা সবকিছুই রোজ মিস করি। কবে যে ক্যাম্পাস খুলবে, আবার আগের মতো একটা হৈহৈ-রইরই রূপে দেখতে পাব প্রিয় ক্যাম্পাসকে, সেই প্রতীক্ষায় আছি।

মেহেরুজ্জামান সেফু, বাংলা বিভাগ 

ছাত্রজীবনে ক্লাস একটি অনন্য স্থান। কেননা সেখান থেকেই জ্ঞান আহরণ করে থাকি আমরা। নিজে নিজে বই পড়ে জ্ঞান অন্বেষণ করা গেলেও প্রিয় শিক্ষাগুরুদের থেকে প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে বুঝতে পারলে তখন সে বিষয়গুলো আরো সহজ হয়ে যায়। তাছাড়া ক্লাসের সহপাঠীদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়গুলো সহজতর করে নেওয়া যায়। ক্লাসের পাশাপাশি ক্যাম্পাসজুড়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো, আড্ডা দেওয়া, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রোগামে অংশগ্রহণ করা এ সবই যেন ছিল জীবনকে উপভোগের প্রাণবন্ত মাধ্যম। 

কিন্তু হঠাৎই সবকিছুই নিষ্প্রাণ, নিস্তব্ধ হয়ে পড়লো। অদৃশ্য এক ভয়াল থাবায় পৃথিবীজুড়ে বিরাজ করলো স্থবিরতা। সবাই হয়ে পড়লাম গৃহবন্দী। ক্যাম্পাসে কাটানো সময়েগুলো খুব মিস করতে শুরু করলাম। দেখতে দেখতে প্রায় এক বছর হতে চললো ক্যাম্পাস বন্ধের। বর্তমানে পরিস্থিতি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া সবকিছুই চলছে অবাধে। তবে কবে খুলবে প্রিয় ক্যাম্পাস, কবে আবার প্রাণ খুলে হাসবো বন্ধুদের সঙ্গে? সব কিছু যখন স্বাস্থ্যবিধি নেমে চলছে, তহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন বন্ধ? সময় যতো গড়াচ্ছে, ততই পড়াশোনার সঙ্গে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। তাই একজন শিক্ষার্থী হিসেবে চাওয়া যতো দ্রুত সম্ভব খুলে দেওয়া হোক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো।

মাহমুদা হক মনিরা, গণিত বিভাগ

করোনা মহামারিতে আমি সবচেয়ে বেশি মিস করেছি আমার ক্যাম্পাসকে। একটা সময় হৈহৈ করে ক্লাসে আসতাম আর ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসের মাঠে বসে বন্ধুরা মিলে কতই না আড্ডা দিয়েছি। ক্যাম্পাসের প্রতিটি ঘাসের ডগায় যেন হাজারো স্মৃতির ভিড়! সবাই মিলে ভেলপুরি খাওয়ার সময়টাও মিস করি খুব। আর মাঝে মাঝে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে চায়ের আড্ডার কথা ভোলার মতো নয়। দীর্ঘ দিন লকডাউনের পর বর্তমানে সব স্বাভাবিক হলেও আমরা শিক্ষার্থীরা এখনো লকডাউনের গণ্ডিতেই আছি। কেননা একটি শিক্ষার্থীর প্রাণই হলো তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

করোনাকে উপেক্ষা করে সবকিছুই করতে পারছি আমরা, কেবল শিক্ষার ক্ষেত্রেই সৃষ্টি হচ্ছে হতাশা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আগে সবকিছুতেই অনেকটা সময় দিতে পারতাম, সময়টা গতিময় ছিল। এখন কেমন জানি সবটা থমকে গেছে। প্রাত্যহিক রুটিনের বাইরের জীবনটা খুবই বিষাদময়, করোনা না এলে বোঝা হতো না। এখন সেই নিরানন্দ আর ব্যস্ত সময়টাকেই খুব করে ফিরে পেতে চাই। 

খাদিজা ইসলাম, বাংলা বিভাগ

তিনি বলেন, ক্লাসের সময়টা অনেক ভালো কাটত, সবাই একসঙ্গে বসে ক্লাস করা, স্যার-ম্যামদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করা, সব মিলিয়ে ক্লাসের সময়গুলো অসাধারণ ছিল, যা আমি প্রতিনিয়ত স্মরণ করি। করোনায় বন্ধের আগে আমি কোনো সংগঠনে জড়িত ছিলাম না। করোনাকালীন সময়ে তিতুমীর কলেজ সাংবাদিক সমিতিতে যোগদান করি, সেই থেকে  আমার হালকা লেখালেখি  চলছে। কলেজের মধ্যে সবচেয়ে মিস করি বান্ধবীদরে। ক্লাস শেষ করে ২/৩ ঘণ্টা আড্ডা দিতাম, প্রতিদিন নিয়ম করে ঝালমুড়ি খাওয়া হতো। 

এখন ক্যাম্পাসে গেলে তাদের কথা খুব মনে পড়ে, কেননা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তারা অনেকেই গ্রামে চলে গেছে। কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠান হতো সেসব অনুষ্ঠানে আমরা সবাই মিলে অংশগ্রহণ করতাম। খুব মজা হতো বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। সবাই একসঙ্গে গান গাওয়া, নৃত্য পরিবেশনের দ্বারা মনটা প্রফুল্ল থাকত। ক্যাম্পাসে দিনের পর দিন চলে যেত টেরই পেতাম না। অনেক দিন তো হলো, তাছাড়া প্রতিষেধক চলে এসেছে এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুব শিগগিরই খুলে দেওয়া হোক এটাই আমার প্রত্যাশা। 

সাইফুল ইসলাম, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ

করোনার আগ মুহূর্তে ক্লাস চলাকালীন সময় আসলে কতটা যে উপভোগ করতাম তা কোন ভাবেই লিখে বা বলে বুঝানো সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলতেই হয় যে, ক্লাস চলাকালীন সময়টা ছিল আমাদের জন্য অনেক আনন্দের। ক্লাসে পড়ালেখার ফাঁকে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেওয়া, গান-বাজনা করা, এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করা, কলেজের মাঠে গোল হয়ে বসে নানারকম আড্ডায় সামিল হওয়া এগুলো ছিল নৃত্য দিনের সঙ্গী। চায়ের সঙ্গে আড্ডা ছাড়া কোনো ভোর হয়েছে কি না আমার মনে নেই। 

সেই আড্ডা, জন্মদিন পার্টি, কেক কাটা, গিফট নিয়ে সারপ্রাইজ হওয়া, শিক্ষকদের স্নেহ পাওয়া, বিভিন্ন বিভাগের বন্ধুদের সঙ্গে গলায় গলা মিলিয়ে গান করা আর হলো না।  আতঙ্ক আমাদের ভিন্ন রকম মানসিকতা সৃষ্টি করে দিয়েছে। আত্মীক বন্ধনে এনেছে কিছুটা দূরত্ব।  তবুও জীবন যাচ্ছে কেটে জীবনের নিয়মে। পিছু ফিরে তাকালে চোখের কোণে জল চলে আসে। কতটা সহজ ছিল জীবন কতটা স্বাধীন ছিল চলাফেরা। তবে ধীরে ধীরে জনজীবন স্বাভাবিকের পথে ফিরে আসছে। করোনার প্রতিষেধকও চলে এসেছে। খুব শিগগিরই প্রিয় ক্যাম্পাস খুলে দেওয়া হোক, এটিই আমার প্রত্যাশা।