ক্যাম্পাস

অধরাই থেকে গেলো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন 

সেদিন ছিল ৬ জানুয়ারি, ২০১৮। প্রতিদিনের ন্যায় সকালে ঘুম ভাঙলো, হাতে ফোন নিয়ে অনলাইনে ম্যাসেজ চেক করতে করতে বিছানা থেকে উঠে বসলাম। তারপর শোবার ঘর ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে রুমে ফিরে আসলাম। মনে অনেক কৌতুহল। আজ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিন। নতুন জায়গা, অচেনা পরিবেশে প্রথম রাত্রীযাপন। তাই খুব উচ্ছ্বসিত ছিলাম।

আমার বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় প্রত্যন্ত গ্রামে অবস্থিত। তখন সেখানে কোনো দোকানপাট ছিল না। সামান্য বিস্কুট, মুড়ি, চানাচুর কিনতে গেলেও দূরে বাজারে যেতে হতো। সেখানে কোনো ভালো একটা বাসা কিংবা মেসও ছিল না, যেখানে উঠবো। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আমি আর আমার বন্ধু একটি বাসার সন্ধ্যান পাই। সেখানেই দুইজন উঠি। বাসায় তো উঠলাম, এখন খাবো কী? পাশে থেকে রুমমেট জাহাঙ্গির এসে বলল, চলো আমরা কয়েক দিন হোটেলে খাওয়া-দাওয়া করবো। তারপর পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা। তাই করলাম। প্রথম একমাস হোটেলে খাওয়া-দাওয়া করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হলাম ও টাকা জমা দিলাম।

ব্যাগে বই, খাতা, কলম, এডমিশন রশিদ ঢোকাতে লাগলাম। একটু একটু কাজ আর ক্ষণে ক্ষণে বিরতি। ইতোমধ্যে এডমিশনের সময় পরিচয় হওয়া বন্ধু শুভ্র ফোন দিলো। আমাকে প্রস্তুতি নিয়ে দ্রুত আসতে বললো। অনেক উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে জুতা, হাতঘড়ি, প্যান্ট-শার্ট, ক্রিম, বডি স্প্রে মেখে ব্যাগ ঘাড়ে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম, তখন আমার কাছে মনে হচ্ছিল ইউনিভার্সিটি নয়, স্কুলে যাচ্ছি। 

ভর্তির পর ওইদিনই (০৬/০১/২০১৮) ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম পদার্পণ। হাঁটার ভঙ্গি, চোখের চাহনি, কথা বলার স্টাইল, সবই একটু আলাদা। ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন হওয়ার আগে একটা প্রবাদ শুনেছিলাম, ফাস্ট ইয়ার, ডোন্ট কেয়ার। আমার কাছেও কেমন জানি এমনই মনে হচ্ছিল আর মনে মনে হাসতেছিলাম। নিজের ডিপার্টমেন্ট খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বেশ খানিক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর পেলাম গন্তব্যস্থল, যেখানে আমাদের প্রথম দিনের ক্লাস হবে।

কিন্তু হায়! ক্লাসে তো কেউ নেই। তাহলে কি ভুল রুমে প্রবেশ করলাম? ভাবতে ভাবতে চতুর্থ তলা থেকে অফিস রুমের দিকে ৫০৭ নম্বর রুমের সামনে আসলাম। এদিকে অফিস কক্ষের সামনে এক অপরিচিতা চোখে চশমা, ভ্যানিটি ব্যাগ কাঁধে, হাতে স্মার্ট ফোন নিয়ে নিজ কাজে ব্যস্ত। ভদ্র পোলার মতো নরম কণ্ঠে বললাম, ‘Excuse me’। মেয়েটি চোখ তুলল। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি কি এই ডিপার্টমেন্টে? অনিচ্ছা সত্ত্বেও উত্তর দিল, হ্যাঁ। প্রথম বর্ষ? হ্যাঁ। পুরাতন, নাকি নতুন? নতুন শব্দটি বেছে নিল সে। 

একটু প্রশান্তি নিয়ে বললাম, আসলে আমিও। আচ্ছা আজ কি ক্লাস হবে? আমার কথায় কান না দিয়ে মোবাইলে কথা বলতে বলতে একাডেমিক বিল্ডিং-৩ এর ২০৪ নম্বর রুমে ঢুকে গিয়ে ফ্যানটা চালু করে বসে বসে ফোনে কথা বলছে। নাছোড় বান্দার মতো পিছু পিছু গেলাম রুমে। ফোনে কথা বলা শেষ হতে না হতেই প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম, আচ্ছা প্রতিদিনের ক্লাস রুটিনটা কোথা থেকে পেতে পারি? মুখ বাঁকা করে আঙুল বাঁকিয়ে দেয়ালে ঝুলানো রুটিনটা দেখিয়ে বলল ওইখানে। আচ্ছা তুমি থাকো আমি গেলাম বলে মেয়েটি রুম প্রস্থান করল।  

তারপর ব্যাগ থেকে খাতা বের করে রুটিনটি সুন্দরভাবে লিখবো এই মুহূর্তে দেখি আমার কাছে কলম নেই। মনে মনে ভাবলাম যাক বাবা, মেয়েটি চলে গেছে ভালই হরো। যদি কলম ধার চেতাম, তবে আমি যে কেমন ছাত্র সেটা প্রথম দিনই বুঝতে আর বাকি থাকত না। কলম কিনতে চলে গেলাম ক্যাম্পাসের গেটের বাইরে। ফিরে এসে দেখি সেই বান্ধবি আর সঙ্গে হিজাব পরা এক মেয়ে ওই জায়গায় বসে ছোটদের মতো চানাচুর, চিপস খাচ্ছে। তাদের পাশের চেয়ারে আসন নিলাম। ফোনের স্ক্রিন দেখে দেখে রুটিন লিখছি আর হালকা হালকা কথা শেয়ার করছি। 

মেয়েটিকে নাম জিজ্ঞাসা করলাম। উত্তর কী দিলো, কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। আবার জিজ্ঞাসা করলাম, ‘স্যরি? এবার একটু জোর করে শব্দ করল উর্মি। আমার পরবর্তী প্রশ্ন ক্লাস কি নিয়মিত হয়, ক্লাস টপিকে কি লেকচার শিট দেওয়া হয়, নাকি স্কুল কলেজের মতো আমাদের বই কিনতে হবে? যদিও প্রশ্নগুলো উর্মিকে উদ্দেশ্য করে ছুড়লাম, উত্তরগুলো পেলাম হিজাব পরিহিত মেয়েটার মুখ থেকে অনেক আগ্রহের সাথে।

তার নাম জানতে চাইলাম। বলল, সানজিদা ইসলাম সাম্মি। বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল নামটা খুব সুন্দর। কিন্তু শেষে সেটা বলার সৎ সাহস আর হলো না। সাম্মির কথা শুনে বুঝলাম সে উর্মির চেয়ে বেশি বন্ধুসুলভ স্বভাবের, অনেকটা মিশুক। যাইহোক, আমার রুটিন লেখা শেষ, এখন শুধু শুধু বসে থাকাটা অসভ্য মনে হলো। তাদের গল্পের শেয়ারবাজার ত্যাগ করলাম। 

তখন ক্যাম্পাসের একাডেমিক বিল্ডিং-১ এর নিচতলা ও দ্বিতীয় তলায় লাইব্রেরি ছিল। লাইব্রেরির সামনে একা একা দাঁড়িয়ে থাকলাম। কারণ সবকিছুই আমার কাছে আজ নতুন। কিছুক্ষণ পর বান্ধবী দুটি আমার সামনে দিয়ে অন্য দিকে চলে গেলো। কোনো কথা হলো না। তারপর একা একা ক্লাসরুমের বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম পরবর্তী ক্লাস কখন হবে।

পোলা-মাইয়াদের একটু আধটু আনাগোনা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। হঠাৎ আমার মতো দেখতে একটা ছেলের আগমন লক্ষ করলাম। কক্ষের ভেতর তার তাকানোর ভঙ্গি দেখে বুঝে নিলাম আমরা একই দলের। কাছে এসে করমর্দন করে শব্দ করলাম স্বপনীল, প্রতিউত্তর করল, ‘আমিনুর’। প্রথম সাক্ষাতে যতটুকু অন্যকে জানা যায়, প্রশ্ন করে জেনে নিলাম। রিদয়ও আমাকে প্রশ্ন করলো বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ কী প্রথম? ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ মাঠের দিকে কিছু পথ যেতেই লম্বা, সুদর্শন, সুঠাম দেহের অন্য একজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ মিলল। আমিনুরের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার একই পন্থা অবলম্বন করলাম। নাম বলল রিদয়। আমি রিদয় ও আমিনুরের ফেসবুক ফ্রেন্ড হতে চেষ্টা করলাম এবং হলাম। তিনজন মাঠের চারপ্রান্তে দুবার আসন নিয়ে একাডেমিক বিল্ডিং-৩ এ ফিরে গেলাম।

ক্লাস রুমে এখন অনেক বন্ধু-বান্ধবি। সবাই পাশাপাশি বসে একেএকে আট নয়জন হয়ে গেলাম। যদিও আমি আজ ক্লাসে প্রথম, তবুও অপরিচিত এই মিলন মেলায় নিজেকে সাইলেন্ট মুডে রাখতে নারাজ। টুকিটাকি প্রশ্ন করতে লাগলাম বিভিন্ন জনের কাছে একে একে কামরুল, জেরিন নয়ন, আলী, মিম, মৃত্তিকা, ইফাত, নাবিলা, রনি ও ফাতেহার সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেলাম।

পরিচিতির মুহূর্ত্যে লক্ষ্যণীয় কাণ্ড, মৃত্তিকা নিজের নামটা প্রকাশ করতে গিয়ে একটু মুখ বাঁকা করে দিলো। আমি খুব শব্দ করে একটু হেসে দিলাম। ভেবে নিলাম মৃত্তিকা  দেখতে শয়তান হলেও একটু বেশিই মিশুক। সবাই মিলে যখন বেশ আড্ডার আসর জমে  উঠল, তখনই সুন্দর একজন ম্যাডাম ক্লাসে এসে উপস্থিত হলো। ম্যাম সবার একে একে পরিচয় নিলেন এবং নিজের পরিচয় দিলেন। কোনো ক্লাস হলো না। সবাই মিলে উঠে পড়লাম। কিন্তু মৃত্তিকা, জুতি, আর শান্তা বসে রইল। বাইরে আসতে না আসতেই একজন বলল, চলো সবাই একটা গ্রুপ ছবি তুলবো। দ্রুত চলে গেলাম ক্লাসরুমের প্রবেশপথের সিঁড়িতে এবং সবাই মিলে একত্র হয়ে ছবি তুললাম। তারপর সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে আসলাম। প্রথম দিন এভাবেই কেটে গেলো, কোনো ক্লাস করা হলো না। আজ দেখতে দেখতে কিভাবে তিন বছর শেষ হয়ে গেলো, বুঝতেই পারলাম না। যখন লিখছিলাম, মনের অজান্তেই কেন জানি চোখের কোণে পানি চলে আসলো, আর ভাবতে লাগলাম বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কি তাহলে শেষ?  কিছু দিন পর আর একসঙ্গে আমাদের দেখা হবে না! তাহলে অধরাই থেকে গেলো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন! 

লেখক: শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।