ক্যাম্পাস

রান্নাঘরে রান্নাবাজি

একে তো বাঙালি আজীবন ভোজনরসিক, তার ভেতর বারো মাসে তের উৎসব। আর উৎসব মানেই রান্নাঘরে রান্নাবাজি। আমাদের আজকের আয়জনে রয়েছে রান্না নিয়ে বাঙালি ইতিহাস-ঐতিহ্যের এবং অঞ্চলভেদে খাবারের কিছু কথা।

আজকের দুনিয়ায় যে খাদ্যসম্ভার পৃথিবীব্যাপী মানুষের রসনা তৃপ্ত করে, তার মূল উপাদান বহু প্রাচীন। আদিম যুগে মানুষ আমিষ-নিরামিষ সবই কাঁচা খেত। ক্রমে ক্রমে যখন আগুন আবিষ্কার হলো তখন পুড়িয়ে খেতে শুরু করল। তারপর থেকেই শুরু হলো রান্নাবান্না নিয়ে নানা ধরনের এক্সপেরিমেন্ট। যা এখন পর্যন্ত বহাল আছে। 

অতীতে ভোজনকে জৈবিক প্রয়োজনের উপাদান মনে করা হলেও এটি যে একটি তৃপ্তি বা আনন্দের অনুভূতি, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। সেই প্রাচীন যুগের কবি কালিদাস বলেছিলেন, ‘আশ্বাস: পিশাচো হপি ভোজনেন’। অর্থাৎ পিশাচকেও ভোজন দ্বারা বাগে আনা যায়। কথাটি বেশ বাস্তবমুখী। আর এতেই বোঝা যায় রান্নাবাজি কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

প্রাচীন যুগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের মূল কাঠামোটি মোটামুটিভাবে ঠিক থাকলেও সময়ের ব্যবধানে ভারতবর্ষে  নানা জাতিগোষ্ঠীর আগমন ও ঔপনিবেশিক আমলে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে প্রতিনিয়তই যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন সব অনুষঙ্গ।

হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে বাংলাতে প্রথম দিকে মাছ, ভাত, দুধ, মিষ্টি এবং শাক-সবজি প্রচলন ছিল বেশি। তারপর সময়ের ব্যবধানে এরা মাংসের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বাংলাদেশি খাবারের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হচ্ছে অঞ্চল ভেদে খাবারের বৈচিত্র্যতা। কত ধরনের খাবার যে বাংলাদেশি মেন্যুতে আছে, তা কল্পনাতীত। স্বাদে ও ঘ্রাণে একটার চেয়ে আরেকটা ঢের বেশি। কিছু আঞ্চলিক খাবারের নাম তুলে ধরা হলো।  

উত্তরাঞ্চলের খাবার 

উত্তরাঞ্চলের খাবারের ভেতর রয়েছে বেশ বৈচিত্র। ‘সিদল’ উত্তরবঙ্গের একটি জনপ্রিয় খাবার। বর্ষা মৌসুমে টাকিমাছ ও কচু ঢেঁকি বা সামগাইন দিয়ে মিশিয়ে মুঠা বা চাকার মতো করে তৈরি করা হয় এক ধরনের খাবার ‘বাংগালি’, তারপর তা শুকিয়ে তাওয়ায় ভেজে তেল, মরিচ, আদা, রসুন ও পেঁয়াজ একত্রে পিষে খাওয়া হয়। এছাড়াও রয়েছে আলুঘাটি, পেলকা ইত্যাদি। 

দক্ষিণাঞ্চলের খাবার 

দক্ষিণাঞ্চলের মজাদার রান্নার কিছু উপাদান হলো চিংড়ি, নারিকেল, চুইঝাল, যা দিয়ে গলা অবধি ভোজন করার পরেও মনে হয় আরও খাই।

এছাড়াও রয়েছে চট্টগ্রামের ‘লইট্ট্যাহাচা’, মণিপুরি ঐতিহ্যবাহী ‘ক্ষার’। রাজশাহী ও চাপাইনবাবগঞ্জের বিখ্যাত ‘কালাই রুটি’। সিলেটের ‘সাতকড়া’। বরিশালের ‘পেয়ার আমড়া ইলিশ’।

রান্নাঘরে রোম্যান্স

এ যেন কড়াই-খুন্তি, মসলা-তরকারির রোম্যান্স। রান্নাঘরের রান্নাবাজিটা তখনই বেশি রোমাঞ্চকর হয়ে ওঠে, যখনই রান্নার শেষে কড়াইয়ে গরম তেলের ভেতর ফোঁড়নের চিড় চিড় শব্দ আর ঘ্রাণে বাড়ি মেতে ওঠে। ফোঁড়নের এই শব্দই যেন গৃহিণীর রান্নার সফলতার কথা জানান দিয়ে দেয়। আর খাবার মজাদার হলে বাড়ির কর্তা যেন গিন্নির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। 

পরিশেষে বলা যায়, রান্না একটি শিল্প, আর রান্নাঘর হলো গৃহিণী নামক শিল্পীর রঙ-তুলিতে আঁকা ক্যানভাস। দেশে-বিদেশে রান্না এবং স্বাদ নিয়ে মানুষের কৌতুহলের কোনো অন্ত নেই। তবে যুগ যুগ ধরে ‘বাঙালি খাবারেই’ সব শ্রেণীর মানুষ বহুগুণ তৃপ্তিলাভ করছে।  

লেখক: শিক্ষার্থী, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।