ক্যাম্পাস

লেখক ও লেখা বাড়ছে কিন্তু মান কেন বাড়ছে না?  

শেষ হতে যাচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। যে বইমেলাকে কেন্দ্র করে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বইপোকাদের পদধূলিতে মুখরিত। এই মেলাকে ঘিরেই যেন এক উৎসবমুখর দিনাতিপাত হচ্ছে শিক্ষার্থী, শিক্ষক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষেরও। যদিও এ বছরের বইমেলাটা ছিল ভিন্ন মোড়কে।

বর্তমান সময়ে পাঠক বাড়ছে, বইয়ের সংখ্যা বাড়ছে, লেখক বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রকাশনীও। কিন্তু বইয়ের মান কি আদৌ বাড়ছে? উত্তর হবে, না। বইয়ের মান এখন আর বাড়ছে না তেমন। বর্তমান লেখকেরা যেন সাহিত্যকে গতানুগতিক উপায়ে উপেক্ষা করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়তই। প্রতি বছর বইমেলা উপলক্ষে বই প্রকাশ পায় প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার অথবা তারও অধিক। এবং তাদের মধ্যে নবীন লেখকেরাই হলো প্রায় অর্ধেকেরও বেশি, অর্থাৎ হাজার তিনেক। কিন্তু বছর শেষে এত এত লেখক, কবি, গল্পকার ইত্যাদি তারা কোথায় হারিয়ে যায়? কেন তারা হারিয়ে যায়? কারণ, তাদের অধিকাংশই শখের বশে নিজস্ব অর্থায়নে বই প্রকাশ করে থাকেন ও পরবর্তী সময়ে সে ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে না পারায় সময়ের স্রোতে তারা একদিন হারিয়ে যান।

আজকাল গল্প সৃষ্টি হচ্ছে, কবিতা সৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে না। হাজার-হাজার কপি বই বিক্রি হচ্ছে, কিন্তু সাহিত্যের বই কতটা বিক্রি হচ্ছে তা নিয়ে সন্দেহ। এমনকি বর্তমান বইগুলোতে অবাধেই ভাষার অপব্যবহার আমরা দেখতে পাই, দেখতে পাই বিদেশি ভাষার অবারিত বিচরণ; কিন্তু কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে সাহিত্য সমালোচকরা বলছেন, আজকাল সাহিত্য সৃষ্টি না হওয়ার পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। যেমন জ্ঞানের অপর্যাপ্ততা, সাহিত্যতত্ত্ব না জানা, শুধু তরুণদের উদ্দেশ্য করে বই লেখা ইত্যাদি। 

এছাড়াও যেসব কারণ রয়েছে, তা হলো বছর-বছর দুই বা ততধিক বই প্রকাশ করা, অপর্যাপ্ত বয়সেই লেখাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া, প্রকাশনীগুলোর অযোগ্য ব্যবহার, বইয়ের নামে পৃষ্ঠা ব্যবসা, লেখক হওয়ার আগে একজন পাঠক ও একজন সমালোচক না হওয়া। এসব কারণেই মূলত বর্তমানে ভালো লেখক ও সাহিত্যিক উঠে আসছে না। 

বর্তমানের অধিকাংশ লেখকই আগে একজন ভালো পাঠক বা সমালোচক নন। তারা ক্লাসিকাল সাহিত্য ও বিদেশি সাহিত্যের ধারে কাছেও থাকেন না। সাহিত্যতত্ত্ব কী, তাদের অধিকাংশই বলতে পারবেন না। তার উপর বছর-বছর একজন লেখকের চারটা পাঁচটা বইও পর্যন্ত প্রকাশ পেতে দেখা যাচ্ছে। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, সে বইগুলোর মধ্যে অনেকগুলো আবার তিনশো-চারশো পৃষ্ঠারও হয়। বাংলা একাডেমির যেন সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। গদবাঁধা গল্পের ঘোরে তরুণদের সময় ও অর্থের অপচয় হচ্ছে সমান তালে। 

এমনকি প্রযুক্তির বিস্তারে কবিও হয়ে উঠছেন স্বঘোষিত আধুনিক কবি, সেলিব্রিটিরাও হয়ে উঠছেন বড় মাপের লেখক! তারা সামান্য ভার্চুয়াল জনপ্রিয়তার মুখে পাঠকদের ঠকাচ্ছে প্রতিনিয়ত এবং খাওয়াচ্ছে খাদ্য কী অখাদ্য সব! তাদের অধিকাংশই বই লিখছে তরুণদের লক্ষ করে, ফলে তাদের সেই বইগুলো সার্বজনীনতা পায় না কখনো। আর প্রকাশনীগুলোর অতিমাত্রায় বৃদ্ধি বাংলা সাহিত্যের অনেক বড় একটি ঝুঁকির কারণ হচ্ছে বৈকি। তারা কিছু টাকার বিনিময়ে প্রকাশ করে দিচ্ছে বই, নেই কোনো প্রুফ রিডিং, নেই কোনো সম্পাদনা, নেই কোনো সংস্করণ। টাকা পেয়ে বই হাতে তুলে দেওয়াই যেন তাদের প্রধান দায়িত্ব এবং কর্তব্য। উপরোক্ত কারণগুলোর জন্যই বর্তমানে ভালো মানের কোনো লেখক উঠে আসতে পারছে না এবং ভালো মানের কোনো সাহিত্যও সৃষ্টি হচ্ছে না।

সাহিত্যের এই খরা রোধ করতে হলে, বর্তমান কবি ও লেখকদের সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে অবশ্যই জ্ঞান থাকা বাঞ্ছনীয়। যেমন ইতিহাস, দর্শন, সমাজতত্ত্ব, সাধারণ বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, বিশ্বসাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাস, বাংলা সাহিত্য, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ও সাহিত্যতত্ত্ব এবং ভাষাতত্ত্ব, এই বিষয়গুলোর জ্ঞান বৈ একজন ভালো মানের সাহিত্যিক হওয়া সম্ভব নয়। সাহিত্যের কাজ শুধু বিনোদন নয়, শিক্ষামূলক বিনোদন দেওয়াই হলো সাহিত্যের কাজ। একটি সাহিত্য হাজার বছরের ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ইত্যাদির প্রতিনিধিত্ব করে। বর্তমান লেখকরা যদি গদবাঁধা সাহিত্যের গণ্ডি থেকে বের হয়ে না আসতে পারে, তবে ভবিষ্যতে বাংলা সাহিত্যের উপর এর প্রভাব ব্যাপক হারে পরিলক্ষিত হবে। এবং ভবিষ্যতে ভাষা ও সাহিত্য অবলুপ্তও হতে পারে। 

তাই বর্তমান লেখকদের সাহিত্যের মূলধারা বজায় রেখে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি এবং নতুন এক সোনালী সাহিত্য জগৎ সৃষ্টি করতে হবে; বই সৃষ্টির ক্ষেত্রে সময় নিতে হবে। যেমন জীবনানন্দ দাশ তার দ্বিতীয় বই প্রকাশে দশ বছর সময় নিয়েছিলেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার সারাজীবনে মাত্র আটটি রচনা সৃষ্টি করে গেছেন। কবি আল মাহমুদ বছর বছর বই প্রকাশ করতে না পারায় এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, কবিতা লেখা ও সাহিত্য রচনা এত সহজ কাজ নয়। 

কবি হেলাল হাফিজ তার সারাজীবনে মাত্র দুইটি বই দিয়ে আজও বহুল আলোচিত ও জনপ্রিয় কবি। সুতরাং, শিল্প সম্মত সাহিত্য সৃষ্টিতে সময় নেওয়া ও অধিক অনুশীলন জরুরি। তবেই না বাংলা সাহিত্য বিশ্ব সাহিত্যে একটি বড় অবস্থান ধরে রাখতে পারবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।