ক্যাম্পাস

মেডিক্যালে সুযোগ পেয়েও ভর্তি অনিশ্চিত মিরাজের 

মো. মিরাজ। থাকেন নোয়াখালী সদর। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস কোর্সের প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেছেন। মেধাক্রমে ৩৭৯৫তম হয়ে জামালপুর শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন তিনি। 

বাবা ফিরোজ উদ্দিন ও মা মালেকা বেগমের তৃতীয় সন্তান মিরাজ। এবছর এইচএসসি পরীক্ষায় নোয়াখালী ন্যাশনাল মডেল কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন।

বর্তমানে থাকেন নোয়াখালী সদর উপজেলার চর শুল্লাকিয়া গ্রামের চাঁদ মিয়ার বাড়িতে। বাবা ফিরোজ উদ্দিন ইট ভাটায় দিন মজুরের কাজ করেন। দিন শেষে যা রোজগার হয়, তা দিয়েই চলে সংসার এবং দুই ছেলে তিন মেয়ের পড়াশোনার খরচ। মা মালেকা বেগম গৃহিণী। পরিবারের বড় ছেলে রিয়াজ উদ্দিন পড়ালেখার পাশাপাশি টিউশন করিয়ে চালাচ্ছেন ছোট ভাই মিরাজের পড়ালেখার খরচ।

হতদরিদ্র ঘরে জন্মগ্রহণ করেও মো. মিরাজ এবার এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। তবুও অভাব-অনটনের কারণে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন ধীরে ধীরে অনিশ্চিত হচ্ছে তার। অদম্য মেধা নিয়ে মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় থাকলেও ভর্তি হতে পারবেন কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। ভর্তির খরচ মেটাতে একমাত্র দুধের গরুটা বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন মা মালেকা বেগম। তাও দুঃশ্চিন্তা, এরপর নিজেদের কী হবে! ছেলের প্রতিমাসের খরচ চালাবেন কী দিয়ে!

মিরাজের ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। পারিবারিক অভাব অনটনে কোনো অবস্থাতেই তিনি স্কুল থেকে বিতাড়িত হতে চায়নি। কারণ লেখাপড়া করে বড় মাপের কিছু হওয়ার স্বপ্ন রয়েছে তার। স্বপ্ন দেখছেন ডাক্তার হয়ে গরীব মা-বাবার মুখে হাসি ফোটাবেন, মানবিক চিকিৎসক হয়ে দেশের কল্যাণে নিজের মেধাকে কাজে লাগাবেন।

মিরাজ বলেন, ‘খেয়ে না খেয়ে পড়াশোনা করে আজকে আমার এই পর্যন্ত আসা। বাবা ইট ভাটায় কাজ করেন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী বাবার পক্ষে সংসার ও আমার পড়ালেখার খরচ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। আমার বড় ভাই পড়াশোনার পাশাপাশি তার টিউশনের টাকা দিয়ে আমার পড়ালেখার খরচ চালিয়েছেন। অভাব অনটনের সংসার। নদী ভাঙনের ভয়ে নিজ বাড়ি থেকে নানার বাড়িতে এসে থাকি।’ 

‘পরিবারের এমন পরিস্থিতিতেও আমি চিকিৎসক হবো, এই স্বপ্ন দেখতাম। পাশাপাশি আমার মা-বাবাও আমাকে নিয়ে এমন স্বপ্ন দেখতেন। একমাত্র বসতভিটাটা ছাড়া আমার পরিবারের আর কোনো সম্বল নেই। আমি ডাক্তার হওয়ার সুযোগ পেয়েও টাকার অভাবে মেডিক্যালে ভর্তি হতে পারবো কিনা সেই দুশ্চিন্তা আমাকে তাড়া করছে। দুধের গরু বিক্রি করে হলেও মেডিক্যালে পড়ানোর ইচ্ছা আমার পরিবারের।’

মিরাজের বড় ভাই রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘আমার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার, কিন্তু পারিবারিক অভাবের কারণে সে স্বপ্ন পূরণ হয় নাই। ২০১৭ সাল থেকে আমার টিউশনের টাকা দিয়ে মিরাজের পড়ালেখার খরচ চালিয়েছি। সামনে ওর মেডিক্যালের খরচ কীভাবে চালাবো, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’

মিরাজের বাবা ফিরোজ উদ্দিন বলেন, ‘আমার মতো গরিব বাবার সন্তান মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে, এ জন্য আমার গর্ব হয়। আমি ইট ভাটায় দিনমজুরের কাজ করি, এই অবস্থায় ছেলের পড়ালেখার খরচ কোথায় পাবো, তা ভেবে কিনারা পাচ্ছি না। যদি সমাজের সচ্ছল, বিত্তবান, সুহৃদ বা কোনো প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসতো, তাহলে আমি আমার ছেলেকে ডাক্তার বানানোর লালিত স্বপ্ন পূরণ করতে পারতাম।’

মা মালেকা বেগম বলেন, ‘খেয়ে না খেয়ে মিরাজকে স্কুলে-কলেজে পাঠিয়েছি। আজ আমাদের পরিবারে খুশির দিন। কিন্তু এই খুশির ভেতর দুশ্চিন্তায় আছি, কীভাবে মেডিক্যালে ভর্তি করাবো। দরিয়ায় স্বামীর বাড়ি ভেঙে যাওয়ার ভয়ে বাপের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। ছেলেকে মেডিক্যালে ভর্তি করানোর সামর্থ আমাদের নাই। একটা দুধের গরু আছে। কিছু না পেলে গরুটা বিক্রি করে হলেও ভর্তি করাবো।’

বিবির হাট রশিদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তুহিনা আক্তার বলেন, ‘মিরাজ আমাদের স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেছে। সে অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থী।  তার মাধ্যমে আমাদের স্কুলের সুনাম বৃদ্ধি পেয়েছে। সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার অনুরোধ করছি।’  

নোয়াখালী ন্যাশনাল মডেল কলেজের অধ্যক্ষ মো. ওবায়দুল্লাহ বলেন, ‘মিরাজ অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হওয়ায় কলেজের বেতন মওকুফ করা হয়েছিল। ক্লাসে পড়ালেখায় তার অসাধারণ কৃতিত্ব ছিল। যদি সে ভালো সুযোগ পায়, তবে সফল হতে পারবে।’