ক্যাম্পাস

বিশ্ববিদ্যালয় হবে জ্ঞানার্জন ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার উদ্যান

বহু অর্জন ও গৌরবময় ইতিহাস নিয়ে শত বছর পূর্ণ করলো প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আজ কথা ছিল প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে ক্যাম্পসের প্রতিটি প্রান্তে আনন্দে-উল্লাসে পালিত হবে বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। কিন্তু বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা মহামারির জন্য ক্যাম্পাস বন্ধ প্রায় দেড় বছর যাবত। এমন পরিস্থিতিতেও শিক্ষার্থীরা থেমে নেই, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ করছেন তাদের স্বপ্নের ক্যাম্পাসকে ঘিরে আবেগের কথা। এমন কয়েকজন শিক্ষার্থীর মতামত তুলে ধরেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদিয়া ইসলাম স্মৃতি।  

ক্যাম্পাস হবে জ্ঞান অর্জন, সংস্কৃতি ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার উদ্যান

মো. হাসিবুল হাসান আদিব, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষা, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বাতিঘর, মুক্তবুদ্ধি চর্চার প্রাণকেন্দ্র এবং গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের লালনক্ষেত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ পূর্ণ করছে তার স্বর্ণালি ইতিহাসের শততম বর্ষ। এই বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় প্রয়োজনের প্রতিটি মুহূর্তে জাগরণের চারণভূমি হিসেবে কাজ করেছে। জাতির বাতিঘর হিসেবে যুগ যুগ ধরে আলো বিলিয়ে চলা গর্বের এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আজ জন্মদিন, শততম জন্মবার্ষিকী। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রভাবে আজ ক্যাম্পাসে বিচরণ নেই শিক্ষার্থীদের। ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা ভয়াবহ সেশনজটে পড়েছে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত ঐতিহ্য ও সুনাম পুনরুদ্ধারে ঢাবির শতবর্ষে প্রত্যাশা থাকবে, যেন দ্রুত আবাসন সংকট নিরসন, করোনায় সেশনজট মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া, সন্ধ্যাকালীন কোর্সসমূহ বাতিল, লাইব্রেরিতে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণায় অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি, সর্বোপরি ক্যাম্পাসে জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত উদ্দেশ্য যেন তুলে ধরা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টা যেন কোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে পরিণত না হয়, সেটাই আশা রাখব। জ্ঞানচর্চা বাদ দিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী যেন প্রমোশন কিংবা ক্ষমতার পেছনে না দৌড়ায় সেটাই প্রত্যাশা করব। তবেই পূর্ণ হবে শতবর্ষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি। ক্যাম্পাস হবে জ্ঞান অর্জন, সংস্কৃতি ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার উদ্যান।

এ যে আমার আপন বিশ্ববিদ্যালয়

সাদিয়া ইসলাম স্মৃতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে দৃপ্ত পায়ে শতবর্ষে পদার্পণ করেছে গৌরব, ঐতিহ্য আর প্রেরণার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় কতশত স্বপ্নের বিবর্তনের সাক্ষী শতবর্ষী আমার এই বিদ্যাপীঠ! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জড়িয়ে আছে ছোটবেলায় শোনা ভাষা আন্দোলন আর স্বাধীনতার গল্পে, ঢাবি মিশে আছে আমার পরিচয় আর অস্তিত্বে। কারণ এ যে আমার আপন বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থী হিসেবে পদচারণার আগে থেকেই ঢাবি ক্যাম্পাস ছিল আমার কাছে এক আবেগের স্থান। 

দেড় বছরের ক্যাম্পাস জীবনেও সেই আবেগে এতটুকু ভাটা পড়েনি, বরং আরও বেশি ভালোবাসা দিয়ে বেঁধেছে। এরপর কোভিড-১৯ নামক ভীনদেশি শত্রুর আগমনে এত দিনের শূন্যতায় প্রিয় ক্যাম্পাসটাও বড্ড অভিমান করে আছে হয়তো! সুনসান নীরবতায় হয়তো সেও খুঁজে ফেরে প্রিয় মানুষের পদচারণা। শতবর্ষের গৌরবময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নীরবে নিভৃতেই শতবর্ষে পা রেখেছে। আজ ক্যাম্পাসের প্রতিটি আঙিনা হয়তো ব্যকুল হয়ে অপেক্ষা করছে অমানিশা কেটে গিয়ে কবে থেমে থাকা সময়টা আবার চলতে শুরু করবে। চেনা মুখগুলোর পদার্পণে মিছিল, মিটিং, স্লোগান, আড্ডা, ঘুরাঘুরি, কোলাহল, লেখাপড়া, গান, থিয়েটার, নাটক, উৎসবে আবারও মুখরিত হবে প্রিয় ক্যাম্পাস, শতবর্ষে এই প্রার্থনা। একইসঙ্গে চলমান সংকটগুলোর সুষ্ঠু সমাধান হোক, গুরুত্ব পাক শিক্ষার মান উন্নয়ন, অম্লান থাকুক শতবছরের গৌরব আর ঐতিহ্য।

বিদ্যমান সংকটগুলোর সমাধান সবেচেয়ে বেশি জরুরি

ফারহান ইশরাক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষার্থী।  তিনি বলেন, উচ্চশিক্ষা লাভের প্রতিষ্ঠান হিসেবে একশো বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। শতবর্ষের সন্ধিক্ষণে এসে একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে, বাংলাদেশের প্রাচীনতম এই বিদ্যাপীঠটির অর্জন ও প্রাপ্তির সংখ্যা অজস্র। বিশেষ করে বাঙালি জাতিসত্ত্বার সতন্ত্র বিকাশ ও পরিপূর্ণতা লাভের দিনগুলোতে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। তাই সময়ের পরিক্রমায় সামর্থের অতিরিক্ত প্রত্যাশার ভারও তৈরি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে। শুধু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী কিংবা শুভানুধ্যায়ী নয়, এখনো দেশের সিংহভাগ মানুষ দারুণ কিছুর আশা করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে। 

তবে, শতবর্ষের এই দীর্ঘ পথচলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান সংকটগুলোর সমাধান হওয়া সবেচেয়ে বেশি জরুরি। বিশেষ করে মানসম্মত গবেষণা বৃদ্ধি, আবাসিক সমস্যার সমাধান, লাইব্রেরি বর্ধিতকরণ, ক্যাম্পাসের যানজট নিরসন, ভর্তি ও অন্যান্য কাজে প্রশাসনিক জটিলতার অবসানসহ প্রভৃতি সমস্যার সমাধান হলে শতবর্ষী এই বিশ্ববিদ্যালয়টির অগ্রযাত্রা নতুন মাত্রা লাভ করবে।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা হয়ে উঠুক সৃজনশীল

সাদিয়া চৌধুরী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী।  তিনি বলেন, ১৯২১ সালের পহেলা জুলাই পূর্ব বাংলায় জ্ঞানদানের জন্য সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই দিন থেকে দিনটি 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস' হিসেবে পালন করা হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তাল মিলিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে চলছে, তাতে নিঃসন্দেহে সেটি প্রশংসার দাবিদার। ৫২'র ভাষা আন্দোলন, ৬২'র শিক্ষা আন্দোলন, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালি জাতির জীবনে যা কিছু বড় বড় অর্জন সবকিছুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। 

১০০ বছরের এই বিদ্যাপীঠ তৈরি করেছে বহু জ্ঞানী, গুণীজনসহ লাখো উজ্জল নক্ষত্র। প্রাপ্তি যেমন আকাশচুম্বী তখন প্রত্যাশা তারও বেশি। ৯৮তম, ৯৯তম এভাবে আজ শতবর্ষে পদার্পণ করলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শতবর্ষে এসে সর্বপ্রথম যেটি লক্ষণীয়, সেটি শিক্ষার গুণগত মান। যেটি ব্যাহত হয়েছে গবেষণা বৃদ্ধি না করার কারণে। র‍্যাংকিংয়ের দিক দিয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু আবাসিক সংকট কাটছে না। পর্যাপ্ত বাজেট, আবাসিক সমস্যার সমাধান, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক বন্ধুসুলভ করা, উন্নয়নমূলক কাজের প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ করা দরকার।প্রত্যাশা করি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা হয়ে উঠুক সৃজনশীল, সুযোগ্য নাগরিক; যারা আগামীতে দেশ পরিচালনা করবেন।

শত জনমের ভালোবাসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মো. জামিন আহমদ, বিশ্ববিদ্যিালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী।  তিনি বলেন, বাঙালি জাতির প্রাণের স্পন্দন বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষে পা দিয়েছে। আমাদের সৌভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, শতবর্ষটি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে হচ্ছে, যা ইতিহাসে যোগ করেছে এক নতুুন মাত্রা। বীরের জাতি হিসেবে বাঙালির রয়েছে এক গৌরবোজ্জল ইতিহাস। আর এসব ইতিহাসের সাথে মিশে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। সুতরাং শতবর্ষে এসে আমাদের প্রত্যাশা একটু বেশিই। 

বলা হয়ে থাকে, যেখানে রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম দেয়, সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেটি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের সাথে জড়িয়ে আছে। শতবর্ষের লগ্নে প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাস আর বৃক্ষ আমার সেই অনুভূতির সাক্ষী। কিন্তুু সেই মধুর অনুভূতি ম্লান হয় প্রিয় প্রতিষ্ঠানের কিছু সমস্যা দেখে। আবাসন সংকট, ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা ও পর্যাপ্ত গবেষণার অভাবের বিষয়টি আমাদের ভীষণ পীড়া দেয়। তাই অন্তত শতবর্ষে এসে এগুলোতে কর্তৃপক্ষ নজর দেবে, সেই প্রত্যাশাই করছি।