ক্যাম্পাস

ওদের আর ফেরা হবে না ক্যাম্পাসে

আকস্মিক করোনার থাবায় চিত্র পাল্টেছে পুরো দেশের। বন্ধের দেড় বছর পর নিজ শিক্ষাঙ্গনে আবার ফিরতে শুরু করেছেন শিক্ষার্থীরা। ধাপে ধাপে খুলে দেওয়া হচ্ছে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ও। মহামারির এই মহা সমীকরণে অনেকের জীবন থেকে বিয়োগ হয়েছেন স্বজন, কেউ বা হারিয়েছেন বন্ধু-প্রিয়জন। 

দীর্ঘ বন্ধে তেমনি পরপারে চিরতরে পাড়ি জমিয়েছেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী। যাদের আর কখনো ফেরা হবে না ক্যাম্পাসে। জীবনের অধ্যায় শুরু না হতেই ঝরে যেতে হয়েছে পৃথিবী থেকে।

ক্যাম্পাসে ক্লাস শুরু হলেও সহপাঠীরা আর পাবেন না তাদের বন্ধুদের। বেঞ্চের কোণায় বসে আড্ডা, দুষ্টুমি, খুনসুটিসহ নানা স্মৃতিই হয়তো তাদের বাঁচিয়ে রাখবে। গত বছরের ২৯ আগস্ট নোবিপ্রবির ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্টে বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী সাইফ উদ্দিন মৃত্যুবরণ করেন। করোনা ও কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর মুগদা হাসপাতালের করোনা ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

সাইফকে স্মরণ করতে গিয়ে তার সহপাঠী ইনফরমেশন সায়েন্স লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্টের শিক্ষার্থী জাহিদ সুলতান বলেন, নোয়াখালীতে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এই প্রথম নতুন জায়গায় থাকা। নোয়াখালীতে বন্ধু বলতে তখনো কেউ নেই, সন্ধ্যায় রুমে বসে আছি হঠাৎ কিছু বড় ভাইদের আগমন। সাইফ বড় ভাইদের সাথে সেখানে ছিল, যদিও আমি প্রথম দেখায় তাকে চিনতে পারিনি। বড় ভাইদের সাথে মিলে গিয়ে প্রথম দর্শনে র‍্যাগিং দেওয়ার পরিকল্পনা আটলো সাইফ। রীতিমতো সফলও হলো সে, পরে জানতে পারলাম র‍্যাগিংয়ের পরিকল্পনাকারী আমার ডিপার্টমেন্টের সাইফ উদ্দিন। তার প্রাণচাঞ্চল্য স্বভাবের কারণেই বন্ধুত্বটা জমে উঠতে তেমন কোনো বেগ পেতে হয়নি।

করোনায় ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা আসলে সবাই যে যার মতো বাড়ি চলে যাচ্ছিল দেখে আমিও ঠিক করলাম কয়েকদিন বাড়িতে থেকে আসি। তাই সন্ধ্যায় আড্ডা দিবো বলে আমি আর বন্ধু আহসান বের হলাম। কিছুক্ষণ পর সাইফের ফোন আসলো, বললাম পৌর পার্ক চলে আয় আড্ডা দেবো, সাইফ আসলে সুপার মার্কেট, পৌর পার্ক হাঁটাহাঁটি আড্ডায় সন্ধ্যাটা মনে রাখার মতোই উপভোগ করলাম। কে জানতো তোর সাথে এটাই আমাদের শেষ দেখা। ক্লাসের ফাঁকের আড্ডা হোক অথবা সন্ধ্যায় চায়ের আসর কিংবা খেলার মাঠের উন্মাদনা সাইফের বিচরণ সব জায়গায় সমান্তরালে, আমাদের কাছে সবসময় একটা নতুন মাত্রা যোগ করতো।

সাইফের আরেক সহপাঠী আহসান হাবিব বলেন, প্রথম দেখাতেই একটা সুন্দর হাসি উপহার পাওয়া যায় যার কাছ থেকে, সে মানুষটাই সাইফ। সেই হাসিটা এখনো চোখে ভাসে, মনে হয় এখনো সাইফ আমাদের সাঙ্গেই আছে। হয়তো কোনো অজানা অভিমানে যোগাযোগ বিমুখ হয়ে গেছে। অনেক সুন্দর মুহূর্ত আছে আমাদের মাঝে সেগুলোর স্মৃতিচারণ লিখে প্রকাশ করা যাবে না। তার রেখে যাওয়া শূন্য স্থান কখনো পূরণ হবে কিনা জানি না। তবে সে সবসময়ই আমার প্রার্থনায় থাকবে। 

ক্যাম্পাসে দুই বছরেরও অধিক সময় একসাথে ছিলাম, মনে হয় অনেক বছর আগেও যেন আমার পরিচিত ছিল সে। সবসময় হাসিখুশি ও পরোপকারী মনোভাবের ছিল। তার জীবনের শেষ সময়টুকুতেও বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতো নিয়মিত, খোঁজ নিতো। আমি বন্ধু নয় একজন ভাই হারিয়েছি। সবসময় দোয়া করি যেন প্রিয় বন্ধু পরপারে ভালো থাকে।

চিরতরে পরপারে পারি জমিয়েছেন নোবিপ্রবির কৃষি বিভাগের ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থী ফারহানুজ্জামান রাকিন। এই বছরের ৩১ মে অজানা কারণে আত্মহত্যা করে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন তিনি।

রাকিনকে স্মৃতিচারণ করে সহপাঠী হুমায়ুন কবির শান্ত বলেন, আসলে রাকিন নিয়ে বলতে গেলে শেষ করা যাবে না। সে আমাদের শুধু বন্ধু না, একজন ভাই। সে আমাদের মতো সাধারণ চিন্তাভাবনার মানুষ ছিল না, যার কারণেই ভার্সিটিতে তার সাথে ফ্রেন্ডশিপ হয়। ভার্সিটিতে আমাদের একটা ক্লোজ সার্কেল ছিল, যার অন্যতম মেম্বার ছিল সে। ক্যাম্পাসে ক্লাসের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় বসে আড্ডা এবং ট্যুর দেওয়া ছিল আমাদের শখ। প্রত্যেকটা ট্যুরেই সে সক্রিয় ছিল এবং ট্যুরের বেশিরভাগ ফটোগ্রাফি করতো সে। 

আড্ডায় আমাদের একটা টপিকও ছিল তার ব্যতিক্রম চিন্তাভাবনা আলোচনা করা। সে প্রচুর মুভি দেখতো।তার শেষ কয়েকমাস সকাল থেকে ঘুমানো পর্যন্ত শুধু মুভি দেখেই কাটিয়েছে। আফসোস যদি সে বাসায় না থেকে আমাদের সাথে থাকতো, একটাবার যদি আমাদের শেয়ার করতে পারতো, হয়তো এখন সে আমাদের মাঝেই আড্ডা দিতো, হয়তো তাকে নিয়েই আমরা মজা করতাম।

রাকিনের আরেক সহপাঠী কাজী ইউনুস তানিম বলেন, রাকিন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার প্রথম বন্ধু। অন্য সবার চাইতে ওর স্বভাব-প্রকৃতি কিছুটা ভিন্নরকম ছিল। ফুটবল আর রক মিউজিকের প্রতি অনুরাগের দিক থেকে আমাদের দুজনের মিল ছিল এবং সে থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একসাথে অনেক মধুর স্মৃতি রয়েছে। একসাথে অনেক আড্ডা, গান, ঘুরাঘুরি, ক্লাস, পরীক্ষা।

রাকিনকে হারানোর ব্যাপারটি এখনো আমাদের সবার কাছে অবাস্তব এক ঘটনা। কেউই বিশ্বাস করতে পারি না আর কখনো রাকিন আমাদের সাথে ক্লাস করবে না, আড্ডা দেবে না। চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে৷ রাকিন হারিয়ে গেছে, একটা বিরাট শূণ্যতা রেখে গেছে, সে শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়৷

ফুল না ফুটতেই গাছ থেকে কলি ঝরার অনুরূপ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু হতে না হতেই পরপারের যাত্রায় শরীক হয়েছেন নোবিপ্রবির সমাজ কর্মবিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী রিমা আক্তার। এই বছরের ৫ এপ্রিল করোনা উপসর্গ নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

রিমার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তার সহপাঠী সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থী সাইফুন নাহার সায়মা বলেন, রিমা ছিল আমার একজন ভালো বন্ধু। ও ছিল অনেক শান্ত স্বভাবের মেয়ে। ওর সাথে ক্লাস চলাকালেও মোটামুটি ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ট হয় ফেব্রুয়ারিতে, যখন আমাদের প্রথম সেমিস্টার  পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল, তখন সে আমাদের মেসে ওঠে। সে ছিল দোতলায় আর আমি ছিলাম তিনতলায়,  প্রায় আমরা একসাথে বসে আড্ডা দিতাম, পরীক্ষার  বিষয় নিয়ে একসাথে  আলোচনা করতাম, একসঙ্গে বসে নোট করতাম।

ওর মৃত্যুর কথা শুনে আমি প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারিনি। কারণ, ও মারা যাওয়ার তিনদিন আগেও ওর সাথে আমার কথা হয়ছে। আসলে ও এত তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে, তা ভাবিনি। ওর স্মৃতিগুলো সবসময় আমার চোখের সামনে ভাসে। দোয়া করি ওই ভালো থাক।

লেখক: শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।