ক্যাম্পাস

সাড়ে ৫ দশক পেরিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় 

দেশসেরা বিদ্যাপীঠগুলোর মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। কালে কালে বহু অর্জনে সমৃদ্ধ এই বিশ্ববিদ্যালয়টি। আয়তনে দেশের সর্ববৃহৎ এবং প্রতিষ্ঠার দিক দিয়ে তৃতীয় এই বিদ্যাপীঠের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৬৬ সালে ১৮ নভেম্বর আজকের এই দিনে। পাহাড়ি অরণ্য আর ভাজে ভাজে দৃষ্টিনন্দন অট্টালিকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়েছে অনন্য রূপ। 

বিচিত্র রঙের পাখি, সবুজ পাহাড়ের কোলে থাকা হরিণ, অজগর কিংবা দুর্লভ প্রাণীর সংরক্ষণশালা যেন এই চবি ক্যাম্পাস। কাটা পাহাড়ের রাস্তা, ঝুলন্ত সেতু, ঝরনাধারা, উদ্ভিদ উদ্যান, জাদুঘর, রহস্যময় চালন্দা গিরিপথ ও সুবিশাল মাঠ দেখলেই মন ভরে যায়। দেশ ও জাতির উন্নয়নে কাজ করছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থী।

১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও পরিকল্পনা ছিল আরও দুই যুগ পূর্ব থেকে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কিন্তু দক্ষিণ বাংলার গুরুত্ব বিবেচনায় এ অঞ্চলেও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন পড়ে। ১৯৪০ সালে চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রথম  ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। তবে ১৯৪২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নূর আহমদ বঙ্গীয় আইন পরিষদে আনুষ্ঠানিকভাবে এই দাবি উত্থাপন করেন। চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত চট্টগ্রাম সরকারি কলেজকে সম্ভাব্য ক্যাম্পাস ধরে পাকিস্তান সরকারের একটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় একটি ‘বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৬২ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনশিক্ষা উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফেরদাউস খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার একটি প্রাথমিক খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করেন। একই বছর নির্বাচন প্রচারণায় ফজলুল কাদের চৌধুরী এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সাধারণ প্রতিশ্রুতি দেন।

চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের স্থানে এই  বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয়। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৬১ সালের ৭ মে চট্টগ্রামে এক প্রতিবাদ সভা হয়, আর এতে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রধান অতিথির ভাষণে চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। ১৯৬২ সালে ৩০ ডিসেম্বর, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ’ নামে আরেকটি পরিষদ গঠিত হয়। পরের বছর, ১৯৬৩ সালের ৮ জানুয়ারি এ পরিষদের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি আরও বেগবান হয়।

প্রথম দিকে এই বিশ্ববিদ্যালয় কুমিল্লায় স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু ১৯৬৩ সালের ১২ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয়টি চট্টগ্রামে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৬৪ সালের ২৯ আগস্ট আইয়ুব খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৬৬ সালে ১৮ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়টি ৪টি বিভাগ নিয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে।

আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। শুরু থেকেই বাংলার প্রখ্যাত ব্যক্তিদের পরশ ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি স্পন্দনে। ৬৯'র গণ অভ্যুত্থান, ৭১'র মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। সূচনালগ্নেই স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিরত তরঙ্গে গা ভাসাতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়টিকে। আর তাতে পিছপা না হয়ে আন্দোলনের পথকেই বেছে নিয়েছিল এখানকার শিক্ষার্থীরা। স্বাধীনতা অর্জনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ছাত্র-শিক্ষক, কর্মচারীর অত্মত্যাগ স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।  প্রতি বছর অসংখ্য শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে কর্মজীবনে সফল হচ্ছেন। এ জাতির সব অর্জনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোঁয়া রয়েছে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এই প্রতিষ্ঠান শুধু দক্ষিণ বাংলায় নয়, পুরো দেশকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে অভূতপূর্ব অবদান রেখে চলছে। 

শত প্রতিকূলতা দূর করে ৫৫ বছর অতিবাহিত করা বিশ্ববিদ্যালয় ঠিক খুঁজে পাবে নিজ গন্তব্য। আর এই গন্তব্য হবে সফলতার চূড়ান্ত সিঁড়ি অতিক্রমের দিকে, বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা হবে, এটা হোক লক্ষ্য। যেটি অর্জিত হলে জাতি উপকৃত হবে দীর্ঘ মেয়াদে। জাতির স্বপ্ন পূরণের সোপান সমুন্নত রাখতে তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আরও বেশি শ্রম দিতে হবে, হতে হবে শিক্ষার্থীবান্ধব।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে চবির প্রাক্তন ও বর্তমান সব শিক্ষক, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীকে জানাই অভিনন্দন। শুভ জন্মদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। দীর্ঘ এই পথচলা অবিরত থাকুক সাফল্য-সমৃদ্ধিতে। 

লেখক: শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।