ক্যাম্পাস

ভয়কে জয়ের স্বপ্ন দেখেন মানিক

মানিক মিয়া। বয়স উনিশ। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। ছোটবেলা থেকেই তিনি সবকিছুতে ভয় পান। কথা কম বলেন, কারও সঙ্গে তেমন মেশেন না। করেন না খেলাধুলাও। মনে রাখতে পারেন না অনেক কিছু। কিন্তু সব বাধা পেছনে ফেলে এবার তিনি অংশগ্রহণ করেছেন এসএসসি পরীক্ষায়।

মানিক শেরপুর সদর উপজেলার পাকুরিয়া ইউনিয়নের তারাগড় নামাপাড়া গ্রামের মো. জয়নাল মিয়া ও মাজেদা বেগমের বড় ছেলে। পরিবারে তার এক ভাই ও এক বোন রয়েছেন। অন্য সাধারণ পরীক্ষার্থীদের মতো তিনি নিজেই খাতায় উত্তর লিখেছেন। ২১ নভেম্বর শেরপুরের আফছর আলী আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে দেখা গেছে এমন চিত্র।

মানিকের বাবা জয়নাল মিয়া বলেন, তার জন্ম ২০০৩ সালের ১ জানুয়ারি। তিন বছর বয়সেও মানিক হাঁটতে বা দাঁড়াতে পারেনি। অল্প অল্প কথা বলতো। সেটাও ছিল অনেকটা অস্পষ্ট। শেরপুর সদর হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হয় মানিককে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী দীর্ঘদিন ওষুধ সেবন ও ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উন্নতি হয়। আস্তে আস্তে দাঁড়াতে ও হাঁটতে শেখে সে। এরপর সাত বছর বয়সে তাকে স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি করি। সেখানে ভালো ফলাফল না করায় মানিককে স্থানীয় আরেকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১ম শ্রেণিতে ভর্তি করি। স্কুলে কারও সাথে মিশতো না। কথা বলতো না। 

স্যার ম্যাডামরা হাজিরা ডাকলে উত্তর দিতো না। তাকে নিয়ে আশপাশের অনেকেই অনেক রকম কথা বলতো। সব পেছনে ফেলে আমরা মানিককে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। আমরা কতদিন বাঁচবো। একসময় তো মানিককে কিছু একটা করতে হবে। সরকারের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার থাকে। মানিক যেহেতু বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। তাই সরকারের পক্ষ থেকে তাকে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দিলে আমরা অনেক উপকৃত হতাম।

মানিকের মা মাজেদা বেগম জানান, মানিকের বাবার অনেক আগ্রহ সে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবে। মা বাবার মুখ উজ্জ্বল করবে। অনেকে মানিককে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করেন। আবার অনেকে বলেন পড়াশোনা করে কী হবে? মানিক তো কিছু মনে রাখতে পারে না। তার বুদ্ধি কম। তাই সব বাদ দিয়ে তাকে বিয়ে করিয়ে দাও। না হয় অন্য কোনো কাজকর্মে পাঠাও। 

তিনি বলেন, মানিককে যখন আমরা বিদ্যালয়ে পাঠাই। তখন তাকে কেউ ধমক দিয়ে বই, খাতা, কলম চাইলে দিয়ে দিতো। আমরা এখনো স্বপ্ন দেখি মানিক একদিন সুস্থ হবে। চাকরি করে আমাদের কষ্ট দূর করবে।

মানিকের সহপাঠী ও প্রতিবেশী আবু সালেহ বলেন, মানিক আমাদের সাথে পড়াশোনা করেছে। যদিও সে বয়সে আমার থেকে বড়। ছোটবেলা থেকেই মানিক একটু আলাদা। বন্ধুদের সাথে মিশতো কম, কথা বলতো কম। বেশিরভাগ সময় মানিক একা থাকতে পছন্দ করতো।

পুঁটিজানা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, মানিককে তার বাবা আমাদের বিদ্যালয়ে ২০১৫ সালে ভর্তি করান। মানিক ও তার ছোট ভাই জানিক একই শ্রেণিতে ভর্তি হয়। মানিক দেখতে স্বাভাবিক হলেও তার মেধা ও বুদ্ধি কম ছিল। সে পড়াশোনায় এতটা পারদর্শী ছিল না, বুঝতো কম। কিন্তু অদম্য ইচ্ছাশক্তি। সে একদিনও বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকতো না। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার পর পাকুরিয়া ইউনিয়নের পুঁটিজানা উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হয় সে। ২০১৮ সালে জিপিএ-২.৭৫ পেয়ে জেএসসি পরীক্ষায় পাস করে। আর এ বছর ওই বিদ্যালয় থেকেই মানবিক বিভাগে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে মানিক। প্রথমে তার সহপাঠীরা তাকে নিয়ে মজা করলেও পরে শিক্ষকদের সহযোগিতায় মানিক ভালোভাবে স্কুল জীবন শেষ করে। 

আফছর আলী আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রধান শিক্ষক জাকির হোসেন জানান, প্রতিবন্ধী যে কোনো শিক্ষার্থীদের জন্য পরীক্ষায় বাড়তি সু্বিধা দেওয়া হয়। মানিককেও প্রতি পরীক্ষায় নির্ধারিত সময় থেকে বাড়তি ২০ মিনিট দেওয়া হচ্ছে।

এ ব্যাপারে পাকুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব হায়দার আলী বলেন, আমি অত্র এলাকার চেয়ারম্যান হিসেবে আনন্দিত। কারণ মানিক বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হয়েও অদম্য ইচ্ছাশক্তি নিয়ে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে। মানিককে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে একটি প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও পুঁটিজানা উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি হিসেবে লেখাপড়ায় তার সব সুবিধা আমি করে দিয়েছি। 

এরপরও যদি মানিকের কোনো প্রকার সমস্যা হয়, তার পরিবার আমার কাছে আসলে আমি বিষয়টি দেখবো। সমাজের অনেকে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদের বোঝা মনে করেন। যেহেতু মানিক লেখাপড়া করছে, সরকার যদি তার প্রতি সদয় হয়ে তাকে একটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে, তাহলে তার পরিবার উপকৃত হবে, বলেন তিনি।