ক্যাম্পাস

টেন্ডার-চাষাবাদে মজেছেন জবির কর্মকর্তা কাজী মনির   

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ক্রীড়া দপ্তরের সহকারী রেজিস্ট্রার কাজী মনির (মো. আব্দুল কাদের)। এই পরিচয়ের বাইরেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা সমিতির সাধারণ সম্পাদক।

প্রভাবশালী এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে উঠেছে নানা অভিযোগ। কর্মকর্তা হয়েও তিনি নতুন ক্যাম্পাসের অধিগ্রহণকৃত জমিতে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই করছেন চাষ। প্রভাব খাটিয়ে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সবার অগোচরেই বসিয়েছেন পানির পাম্প। বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছ চুরি, পুকুরে অনুমতি ছাড়াই সকলের অগোচরে মাছ চাষসহ নানা বিতর্কিত কাজে জড়িয়েছেন তিনি। এতে সমালোচনার মুখে পড়লেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। 

অভিযুক্ত কর্মকর্তা কাজী মনির বসবাস করেন ঢাকার কেরানীগঞ্জে অবস্থিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাসের পাশেই। নতুন ক্যাম্পাসের জমিতে সবজি-মাছ চাষ করছেন অনুমতি ছাড়াই। এছাড়া সেই জমি চাষের জন্য সেচের ব্যবস্থা করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি ছাড়াই তোড়জোড় করে পানির পাম্প বসিয়েছেন তিনি। কাজের অনুমতি না থাকায় ও কম গভীরে পাম্প বসানোয় বিশ্ববিদ্যালয় সেটি তুলে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু সেই নির্দেশ অমান্য করে বহাল তবিয়তেই রাখা হয়েছে পানির পাম্প।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাসে প্রায় ৫ লাখ ৯৫ হাজার টাকার পানির পাম্প বসানোর প্রকল্পের কাজ পান অমিত কুমার নামে এক ঠিকাদার।  সেই কাজের অনুমতি (ওয়ার্ক অর্ডার) দেয়া হয়নি বলে কাজ করেননি তিনি। তবে তার অগোচরেই পানির পাম্প বসান কাজী মনির। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়ার পরও কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়েই কম গভীরতায় নিজ উদ্যোগে পানির পাম্প বসান কাজী মনির। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তর আপত্তি জানায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তর সূত্রে জানা যায়, পানির পাম্প বসানোর জন্য টেন্ডার হলেও কাজের অনুমতি দেয়া হয়নি। কাজের অনুমতির পর উপযুক্ত জায়গায় পাম্প বসানোর পরিকল্পনা ছিল কর্তৃপক্ষের। যাতে নতুন ক্যাম্পাসের কাজ শেষে সেটি তুলে ফেলতে না হয়।

তবে অভিযুক্ত কাজী মনির নিজে ঠিকাদার না হয়েও প্রভাব খাটিয়ে সবার অগোচরে একদিনের মধ্যেই সেই পাম্প বসান বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যানে নির্ধারিত পুকুরের জায়গায়। ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়ার পরও তার এমন কর্মকাণ্ডে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন দপ্তরে নানা সমালোচনার সৃষ্টি হয়। সমালোচনার পরও তা অপসারণে কোনো উদ্যোগ নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাজী মনির বলেন, ‘আন্তঃবিভাগ ফুটবল টুর্নামেন্টের খেলা শুরু হয়ে যাওয়ায় ভিসি এবং ট্রেজারার পাম্প বসানোর জন্য ইমার্জেন্সি অনুমোদন দিয়েছিল। সেজন্য পাম্প বসানো হয়েছে।’

নিজে ঠিকাদার না হয়েও ওয়ার্ক অর্ডার ছাড়াই কাজের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই ওয়ার্ক অর্ডার হয়েছিল। ওয়ার্ক অর্ডার হওয়ার পরই ঠিকাদারের মাধ্যমে কাজ হয়েছে। যেহেতু আমি এখানে থাকি তাই আমি শুধু কাজের তদারকি করেছি। কাজ ঠিকাদারের মাধ্যমে হয়েছে।’

তবে কাজের ঠিকাদার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী বলেন ভিন্ন কথা। কাজী মনিরের সঙ্গে সমন্বয় করে পাম্প বসানোর কাজ করেননি বলে দাবি করেন ঠিকাদার অমিত কুমার।

এ বিষয়ে অমিত কুমার বলেন, ‘পাম্প বসানোর কাজ আমি পেয়েছি। আমাকে ক্রীড়া দপ্তর থেকে বলা হয়েছিল পাম্প বসাতে। কিন্তু ওয়ার্ক অর্ডার (কাজের অনুমতি) না পাওয়ায় কাজ করিনি। কারা পাম্প বসিয়েছে তা আমার জানা নেই।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, ‘ওয়ার্ক অর্ডার হওয়ার আগেই কাজী মনির ওখানে পাম্প বসিয়েছিল। ওটার কোনো অনুমতি ছিল না। আর গভীরতাও খুব অল্প ছিল। সেজন্য আমরা তুলে ফেলার কথা বলেছিলাম।’

এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিগ্রহণকৃত জমিতে অনুমতি ছাড়াই চাষে নিয়োজিত রয়েছেন কাজী মনির। ক্রীড়া দপ্তরের কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত থাকায় মাঠের পাশেই কয়েক বিঘা জমিতে চাষাবাদ করছেন তিনি। সরেজমিনে দেখা যায়, কর্মকর্তা কাজী মনিরের কোনো জমিতে লাউ, টমেটো, বেগুন, পেঁয়াজ, রসুন, পালংশাক, লালশাক চাষ হচ্ছে। ক্ষেতে পানি দেওয়ার জন্য দেখা গেছে সেচের পাইপও। এসব জমিতে সেচের ব্যবস্থা করতেই কাজী মনিরের তড়িঘড়ি করে পাম্প বসানোর একটি কারণ বলে অভিযোগ উঠেছে।

কাজী মনিরের ক্ষেতে কাজ করা এক কৃষক জানান, ‘জগন্নাথের কর্মকর্তা কাজী মনির স্যার আমাকে জমির আগাছা নিড়াতে বলেছে। আগে পাইপ লাগিয়ে সেচ দেয়া হতো। এখন খেলার মাঠে পাম্প বসিয়েছেন তিনি। ওখান থেকে ক্ষেতে সেচ দেয়া যাবে। শুধু খাবারের জন্য নাকি বিক্রির জন্য এ চাষ-প্রশ্নে তিনি আরো জানান, খাওয়ার জন্য এতো বিঘা চাষ করে। এসব শাক-সবজি বিক্রি করা হয়।’

এ বিষয়ে অভিযুক্ত কাজী মনির বলেন, ‘আমি চাষাবাদ করে কি অপরাধ করেছি? আগে এখান থেকে মাটি চুরি হয়ে যেতো। এখানে জমি দেখাশোনা করি বলে এখন আর চুরি হয়না। এতে আরও উপকার হয়েছে।’

এদিকে সম্প্রতি মুজাহিদনগর মাদরাসার সড়কের পাশে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জমিতে বেশ কয়েকটি মোটা আকাশমণি গাছ কাটা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। সেসময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ, শিক্ষক সমিতি ও প্রকৌশলী দপ্তরের কর্মকর্তারা নতুন ক্যাম্পাস পরিদর্শন করেন। সেসময় কোষাধ্যক্ষ  অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদকে বলা হয়, কর্মকর্তা সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী মনির এসব গাছ কেটে রেখেছেন। তখন ট্রেজারার বলেন, ‘এখানে ক্যাম্পাসের বিল্ডিং করা লাগবে মনে হয়।’ তখন কর্মকর্তাদের মধ্যে উত্তর আসে, মনির গরুর খামার করবে, তাই গাছ কেটে রেখেছে। সেই সময় উপস্থিত একাধিক সিনিয়র অধ্যাপক ও কর্মকর্তা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

এর আগে নতুন ক্যাম্পাসে মাছ চাষ করে সমালোচনার মুখে পড়েন কাজী মনির। নতুন ক্যাম্পাসে ২০-৩০টি পুকুরে মাছের পোনা ছাড়েন তিনি। পানি কমে গেলে পাশের পুকুর ও খাল থেকে মাটি কেটে পানি ঢুকান তিনি। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই জানতে পারলে সমালোচনার মুখে মাছ চাষ থেকে সরে আসেন মনির।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘আমি এই বিষয়ে কথা বলতে চাই না।’ এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার এবং প্রকল্প পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কমিটির আহ্বায়ক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এর সঙ্গে কথা বলতে বলেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ও প্রকল্প পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কমিটির আহ্বায়ক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রকৌশলী মো. ওহিদুজ্জামান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ইমার্জেন্সি পাম্প বসানোর কোনো অনুমোদন দেওয়া হয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই। এটা প্রকৌশল দপ্তর ভালো বলতে পারবে। আর বিশ্ববিদ্যালয় কাউকে জমি চাষাবাদ করার জন্য কোনো অনুমতি বা ইজারা দেয়না।’

এ বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ইমদাদুল হকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।