ক্যাম্পাস

‘ইভটিজিং প্রতিরোধে সামঞ্জস্য শিক্ষাব্যবস্থা আনয়ন জরুরি’

সভ্য সমাজের অসভ্য রূপ হচ্ছে ‘ইভটিজিং’। প্রতিনিয়ত এই নীরব ঘাতকের সম্মুখীন হোন অনেক নারী। নারী উত্ত্যক্তকরণকে ঘিরে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের (গবি) কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক নীলুফার সুলতানা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সানজিদা জান্নাত পিংকি।

প্রশ্ন: ইভটিজিং বলতে মূলত কী বুঝায়?

অধ্যাপক নীলুফার সুলতানা: ‘ইভটিজিং’ শব্দটা নতুন হলেও ঘটনা বা বিষয়টি নতুন নয়। এই শব্দটি শুনলেই আমাদের মাথায় আসে একটি ছেলে কর্তৃক একটি মেয়েকে উত্ত্যক্তকরণ। এর উল্টোটাও হতে পারতো। কিন্তু সেটি সমাজে প্রচলিত নয়। এজন্যই আমরা ‘টিজিং’ শব্দটির সাথে ‘ইভ’ যোগ করতে পারলেও ‘এডাম’ যোগ করতে পারিনি। যার মূলে রয়েছে সমাজে নারীদের অধঃস্তন অবস্থান। নারী ও পুরুষের মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ থাকাটা প্রাকৃতিক বিষয়। কিন্তু এই বিষয়টাকেই কতিপয় মানুষ চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে অস্বাভাবিক করে ফেলে। আর এই পারস্পরিক টান থেকে উত্ত্যক্তকরণ বিষয়টি উদ্ভুত।

প্রশ্ন: ইভটিজিং কাদের দ্বারা হয়? এর পিছনে কারণ কী?

অধ্যাপক নীলুফার সুলতানা: ‘ইভটিজিং’ শব্দটি অবলোকন করলে এর অর্থ শব্দের মধ্যেই নিহিত আছে। ‘ইভ’ বলতে নারীকেই বোঝানো হয়। পুরুষ কর্তৃক নারীর প্রতিই এটি হয়ে থাকে। এর পেছনের কারণ খুঁজতে গেলে প্রাকৃতিক একটা বিষয় বেশি হাইলাইট হবে। যদি আমরা চারশো-পাঁচশো বছর আগে শেক্সপিয়ারের সময়েও চলে যাই সেখানেও দেখা যাবে রোমিও জুলিয়েটকে উত্যক্ত করেছে। অর্থাৎ এটি নতুন বিষয় নয়। নারীপুরুষের যে আকর্ষণ এটাই ইভটিজিং এর জন্য মূখ্য নিয়ামক।

প্রশ্ন: নারীদের পোশাক ও চলনভঙ্গিকে যারা ইভটিজিং এর কারণ মনে করেন, তাদের সম্পর্কে কী বলার আছে?

অধ্যাপক নীলুফার সুলতানা: অনেকেই ইভটিজিংয়ের জন্য পোশাককে দায়ী করেন। যা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। কেননা কিছু ঘটনাগুলো আমলে নিলে দেখা যাবে খুবই শালীন পোশাকের মেয়ে, মাথায় হিজাব পরেন এমন মেয়েও টিজিংয়ের শিকার হচ্ছেন। আসলে যারা মেয়েদের বিরক্ত করে এটা তাদের একটা অজুহাত। তাদের দূষিত দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেই তারা এই অজুহাত দেয়। কোন পোশাক ভালো বা মন্দ, কোন নারীর চলনভঙ্গি ভালো নয়, এসব তারা কিসের প্রেক্ষিতে বিচার করেন? আমি মনে করিনা পোশাক বা নারীর চলনভঙ্গি টিজিংয়ের পেছনের মূল কারণ। অসুস্থ মানসিকতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই কতিপয় মানুষ এই বিষয়টি মূল কারণ হিসেবে গণ্য করেন।

প্রশ্ন: সমাজে ইভটিজিংয়ের প্রভাব কতটা, এর ভয়াবহতা প্রতিরোধে পরিবারগুলোর কী ধরনের ভূমিকা রাখা প্রয়োজন?

অধ্যাপক নীলুফার সুলতানা: সমাজে ইভটিজিং এর প্রভাব যে কতটা ভয়াবহ তার নজির আমরা দেখেছি। এমনকি অনেক ভুক্তভোগীকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে দেখেছি। এই সমাজ তাদেরকে রক্ষা করতে পারেনি। এক্ষেত্রে পরিবারের শিক্ষাটা অনেক জরুরি। আমরা কি নিজের ছেলে সন্তানকে সেই শিক্ষাটা দিচ্ছি? বরং মেয়েরা যখন টিজিংয়ের শিকার হচ্ছে মেয়েকেই সচেতন হয়ে চলাফেরার বিষয়ে বললেও ছেলেকে সাবধান করি না। প্রতিটা পরিবারেরই দায়িত্ব মেয়েকে সামাজিকীকরণের পাশাপাশি ছেলেকেও সঠিক শিক্ষা দেয়া।

প্রশ্ন: মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে সমাজ ও রাষ্ট্র কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে বলে মনে করেন?

অধ্যাপক নীলুফার সুলতানা: যে কোনো অবক্ষয় কিংবা দায়িত্বপালন পরিবার থেকেই শুরু হয়। একই সঙ্গে সমাজ, রাষ্ট্র প্রত্যেকেরই দায়িত্ব আছে। যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত আছে সেটার পরিবর্তন দরকার। এই যে অবক্ষয়গুলো কিভাবে রোধ করবো সেটা শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত হওয়া জরুরি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখন হরেক রকমের হয়ে গেছে। এই ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে যে সামঞ্জস্যতা দরকার তা ব্যাহত হচ্ছে। একজনকে শেখাচ্ছি ইহলৌকিক, অপরজনকে জানাচ্ছি পরলৌকিক  বিষয়। এজন্য মূল্যবোধের শিক্ষা একেকজনের কাছে একেকরকম থেকে যাচ্ছে, আমরা সাংঘর্ষিক হয়ে যাচ্ছি। সামঞ্জস্য শিক্ষাব্যবস্থা আনয়ন জরুরি।

প্রশ্ন: নারী নিরাপত্তা প্রশ্নে ইভটিজারদের দমন কৌশল কী হতে পারে?

অধ্যাপক নীলুফার সুলতানা: প্রথমত, সুস্থ মানসিক গঠন নিয়ে ভাবতে হবে। দ্বিতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এ বিষয়ে কঠোর হতে হবে। ইভটিজিং এর যে শাস্তি আছে সেটা প্রকাশ্যে হতে হবে, সবাই যেন জানতে পারে ইভটিজিং করলে কি শাস্তি হয়। এক্ষেত্রে মানসিক গঠন না হলেও অন্তত অপরাধীর নিকট একটা মেসেজ পাঠানো সম্ভব হবে এর ভয়াবহতা কতটা। এতে তারা সংযমী হবে এবং জানতে পারবে যে একজনকে এভাবে উত্যক্ত করে সে পার পাবে না।

প্রশ্ন: ইভটিজিং নামক ব্যাধি প্রতিরোধে নারীরা কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে?

অধ্যাপক নীলুফার সুলতানা: প্রতিটা নারীকেই প্রতিবাদী হতে হবে। তাদেরকে প্রতিবাদের ভাষা শিখতে হবে। তাদের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করতে হবে। তাছাড়াও এখন কিন্তু সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে এগুলো রোধে। সরকারি যে সেবা ব্যবস্থা আছে সেগুলার পূর্ণ ব্যবহার করতে হবে। ৯৯৯ বা এ জাতীয় যে সুযোগ সুবিধাগুলো আছে সেগুলা ব্যবহার করতে হবে। প্রতিটি মেয়েকেই প্রতিবাদী এবং আত্মরক্ষার কৌশল জানতে হবে। পাশাপাশি ‘মা’ নারীদেরকে তার ছেলে সন্তানকে সঠিক শিক্ষায় বড় করতে হবে।

প্রশ্ন: সমাজে পুরুষদের তুলনায় নারীর অবস্থান দূর্বল হওয়াতে অনেক জায়গায় ইভটিজার সুবিধা পায়। এক্ষেত্রে, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি কী ইভটিজিং কমাতে পারে?

অধ্যাপক নীলুফার সুলতানা: সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই মানুষকে ‘মানুষ’ হিসেবে গড়তে পারি, এটাই শেষ হাতিয়ার। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ক্যাম্পিং করা যেতে পারে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

প্রশ্ন: ইভটিজিং সমস্যায় পুরুষতান্ত্রিকতা কতটা দায়ী বলে মনে করেন? নারীকে সম্মানের জায়গায় পৌঁছে দিতে এবং ক্ষমতায়ানে অধিষ্ঠিত করতে রাষ্ট্রের করণীয় কী হতে পারে?

অধ্যাপক নীলুফার সুলতানা: পুরুষতান্ত্রিকতা শতভাগ দায়ী। ইভটিজিং তো অবিবাহিত সম্পর্কে সীমাবদ্ধ নয়। বিবাহিত জীবনেও অনেকেই এমন সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। বিবাহিত নারীও বিভিন্ন কটু কথা শোনেন প্রতিনিয়িত। পরিবারে ভাই নিজেকে বোনের বিপরীতে সুপিরিয়র মনে করে। এগুলোকে ‘ডমিস্টিক টিজিং’ বলা যেতেই পারে। নারীর উত্ত্যক্তকরণ দূরীকরণে রাষ্ট্র যে একেবারেই কিছু করছে না তা কিন্তু নয়। নারীর ক্ষমতায়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নিরাপত্তার ব্যবস্থা দেওয়ার প্রচেষ্টা রাষ্ট্র প্রতিনিয়ত করছে। মূলত এটি রাতারাতি মুছে ফেলার মতো বিষয় না। প্রতিনিয়ত সমাধান নিয়ে কাজ করতে করতেই আমরা সমাজ থেকে নারী উত্ত্যক্তকরণ কিছুটা হলেও দূরীভূত বা দমিয়ে রাখতে পারবো বলে আমি আশাবাদী।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।