মা—এই ছোট্ট একটি শব্দের ভেতর লুকিয়ে আছে সমগ্র পৃথিবীর কোমলতা, সহানুভূতি আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। মা যেন এক ছায়াদার বটবৃক্ষ, যে নিজের পাতা-শাখা মেলে আগলে রাখে তার সন্তানকে। নিজে রোদে-পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে তবু সন্তানের গায়ে যেন একটি কষ্টও লাগতে দেন না।
ছোটবেলাটা যেন ছিল একটুকরো রঙিন কল্পনার রাজ্য, যেখানে মা ছিলেন রাজরানী আর আমি তার একমাত্র রাজপুত্র। তখনকার সবচেয়ে প্রিয় কাজ ছিল, মায়ের কাছে কিছু না কিছু কেনার বায়না ধরা। পাড়ার দোকানটা তখন আমার কাছে ছিল যেন এক জাদুর ঘর। কাঁচের তাকের ভেতরে সাজানো রঙিন ট্রফি, চকোলেট, নতুন পেন্সিল, ছোট খেলনা—সবই যেন আমার চোখে আলাদা এক মোহ ছড়াতো।
যখন দোকানের পাশ দিয়ে হাঁটতাম, মায়ের আঁচল ধরেই মৃদু গলায় বলতাম, “মা, ওইটা কিনে দাও না!” মা প্রথমে না করে দিতেন। বলতেন, “তোর তো বাসায় অনেক আছে!” আমি তখন মুখ ফুলিয়ে রাগ করে হাঁটতাম কয়েক কদম। আর ঠিক তখনই মা চুপিচুপি আমার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বলতেন, “যা, নিয়ে আয়, কিন্তু সব এখনই খাস না!”
জীবনের প্রথম শব্দ শেখা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত, প্রতিটি বাঁকে মা ছিলেন আমার পাশে। যখন সবাই ব্যস্ত, মা তখনো আমার চোখের ভাষা বুঝতেন। ছোটবেলায় খেলনা ভাঙলে যেমন মাকে দোষ দিতাম, আবার কান্না পেলে তিনিই বুক পেতে দিতেন। দুঃখ-বেদনায় তিনি আমার নির্ভরতার আশ্রয়, সুখে-দুঃখে একমাত্র নিঃস্বার্থ সঙ্গী। বন্ধু অনেকেই হয়, কিন্তু মা আমার এমন একজন বন্ধু, যিনি কখনোই বদলান না। তার ভালোবাসা, ধৈর্য আর সাহস আমার পথ চলার প্রেরণা।
মায়ের ভালোবাসা কোনো শর্তে বাঁধা নয়। সে ভালোবাসা চায় না কোনো প্রতিদান, চায় না স্বীকৃতি। আমার হাসিই যেন তার জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার। মা, আমার কাছে দিনের আলোয় কাজের কণ্ঠস্বর, রাতের অন্ধকারে একটুকরো নরম চাঁদের আলো। তিনি ক্লান্ত হন, কষ্ট পান, তবু আমাকে তা বুঝতে দেন না। নিজেকে মুছে দিয়ে আমাকে রঙিন করে তোলাই যেন তার জীবনের একমাত্র ব্রত। যেমন ব্রত ছিল ঈশ্বরী পাটনির, “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।”
মা সবসময় নিজেকে উজাড় করে দিতে জানেন; কখনো নিতে জানেন না। আমার প্রতি মায়ের প্রত্যাশা সাধারণত নিঃস্বার্থ, গভীর ও আবেগপূর্ণ। এটি শুধু নিজের সন্তানের সাফল্য বা উন্নতির আকাঙ্ক্ষা নয়, বরং আমার নৈতিক গুণাবলি, সুস্থতা ও সুখের জন্য এক গভীর আত্মিক প্রার্থনা।
মা আমাদের পৃথিবীতে আসার প্রথম আশ্রয়, ভালোবাসার প্রথম পরিচয়। শৈশবে তিনি যেমন নিঃস্বার্থভাবে আমার যত্ন নিয়েছেন, তেমনি তার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমিও দায়িত্ব নিয়েছি তাকে ভালোবাসা, সম্মান ও যত্নে রাখার। তার প্রয়োজনে পাশে থাকি, তার স্বাস্থ্য ও মানসিক সুখ নিশ্চিত করার চেষ্টা করি। মা যেন কখনো একাকী না হন—সেই খেয়াল রাখি। কারণ, মা কেবল একজন মানুষ নন, তিনি এক জীবনভর ছায়া হয়ে থাকা আশীর্বাদ।
(লেখক: শিক্ষার্থী, মাস্টার্স, অর্থনীতি বিভাগ, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়)