ক্যাম্পাস

রূপোর মালায় কেনা ভালোবাসা

আমাদের সংসারে বিলাসিতা শব্দটা বড় অচেনা ছিল। বাবা তখনো কাজ খুঁজছেন, মা কখনো হাঁস-মুরগির ডিম বিক্রি করতেন, আবার কখনো পিঠা বানিয়ে বিক্রি করতেন। টানাটানি ছিল সংসারে। কিন্তু ভালোবাসার কোনো অভাব ছিল না ।

আমি তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। স্কুলে এক বন্ধু নতুন সাইকেল নিয়ে আসত, লাল রঙের। বেল বাজলে মনে হতো পুরো পাড়া নেচে উঠছে । আমারো সাইকেল দেখে খুব চালাতে ইচ্ছে করতো। বন্ধুটি তার নতুন সাইকেল কাউকে ধরতে দিত না। যক্ষের ধনের মত আগলে রাখত। 

একদিন সাহস করে বলেই ফেললাম, “আম্মু, আমারো সাইকেল চাই।”

মা তখন কাপড় শুকাচ্ছিলেন। মা মলিন মুখে হালকা হাসলেন। কিছু বললেন না। শুধু বললেন, “তুই ফার্স্ট হ না এইবার? দেখিস আমি দেই কি না। পড়াশুনায় তো মন নাই।”

আমি জানতাম, আম্মুর পক্ষে সাইকেল কেনা মানে এক মাসের বাজার কম করে ফেলা। এত টাকা জোগার করা মায়ের পক্ষে অসম্ভব। 

সাইকেলের লোভে আমি প্রচুর পড়তাম। স্বপ্নে দেখতাম শুধু সাইকেল চালাচ্ছি। অবশেষে আমার কঠোর পরিশ্রমের ফল পেলাম। রেজাল্টের দিন দেখলাম, আমি প্রথম হয়েছি। সনদ হাতে বাসায় ফিরলাম। মা আমাকে বুকে জড়িয়ে বললেন, “তুই তো কথা রাখলি, এবার আমার পালা।”

দুইদিন পর মা আমাকে নিয়ে গেলেন পুরাতন একটা দোকানে। সেখান থেকে একটা হালকা পুরনো একটা সাইকেল কিনলেন। আমি চোখ বড় করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি এটা কিনলে কিভাবে?”

মা শুধু বললেন, “আমার রূপার মালা বেচে দিয়েছি তোর সাইকেলের জন্য। ভালো করে পড়, একদিন তুই নিজেই গাড়ি কিনতে পারবি।”

আমি সাইকেলটা ছুঁয়ে দেখার আগেই চোখে জল চলে এল। দেখি, মায়ের চোখেও ঠিক তেমনি জল। পার্থক্য, আমারটা আনন্দের, আর মায়েরটা ত্যাগের।

এই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে দামি চুক্তি। মায়ের জমানো টাকায় কেনা একখানা ভালোবাসা।

(লেখক: শিক্ষার্থী, মাস্টার্স, আইন বিভাগ, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি, ঢাকা)