ক্যাম্পাস

জাবিতে ছাত্রী হলের ওরিয়েন্টেশনে রাত ১০টার আগে হলে ফেরার নির্দেশনা

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ১৫ নম্বর ছাত্রী হলে (সাবেক বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল) নবীন বরণ উপলক্ষে উপহার সামগ্রীর সঙ্গে ‘শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ ২০১৮’-এর একটি কপি বিতরণ করা হয়।

সেখানে ‘রাত ১০টার মধ্যে হলে ফিরতে হবে’ এবং ‘ভোর ৫টার আগে আবাসিক শিক্ষকের অনুমতি ছাড়া বের হওয়া যাবে না’ এমন বিধান উল্লেখ থাকায় এটি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পক্ষে-বিপক্ষে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে নানা বিতর্কও।

গত ২১ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের (৫৪তম ব্যাচ) নবীন শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হয়। এর আগে ২০ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন আবাসিক হলে আনুষ্ঠানিকভাবে নবীনদের বরণ করা হয়। এদিন ১৫ নম্বর ছাত্রী হলে নবীন শিক্ষার্থীদের একটি স্বচ্ছ ফাইলে কলম, পেন্সিল, রাবার ও দুটি চকলেটের সঙ্গে দেওয়া হয় ‘শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ- ২০১৮’ শীর্ষক কাগজ।

সেই কাগজে কালো অক্ষরে লেখা ছিল ‘বিধিমালা: হল সংক্রান্ত’। এর ‘ন’ ধারায় বলা হয়, হলে বসবাসরত ছাত্র/ছাত্রীকে রাত ১০টার মধ্যে নিজ নিজ আবাসিক হলে ফিরে আসতে হবে এবং ভোর ৫টার আগে আবাসিক শিক্ষকের অনুমতি ছাড়া হল থেকে বের হওয়া যাবে না।

পরবর্তীতে ওই ফাইলের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থীরা বলছেন, ২০১৮ সালে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সাবেক ভিসি ফারজানা ইসলামের সময় তৈরি করা বিতর্কিত বিধিমালাটির কপি ওরিয়েন্টেশনের উপহারের ফাইলে দেওয়া সমীচীন হয়নি।

শিক্ষার্থীরা জানায়, ১৫ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ ও জাবির সহকারী প্রক্টর সহকারী অধ্যাপক শামীমা নাসরিন জলি ওই বিধিমালার কাগজটি দেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব-নিকাব পরিধান করায় এর আগে আলোচিত হয়েছেন।

এদিকে, এই বিধিমালার কাগজ সংযুক্তির বিষয়টি নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। ফেসবুকে পোস্ট করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন শিক্ষার্থীদের অনেকেই।

তারা জানান, ফ্যাসিস্ট সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার বান্ধবী হিসেবে পরিচিত জাবি উপাচার্য ফারজানা ইসলামের সময় ২০১৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ’ নামে এই অধ্যাদেশ তৈরি করা হয়। এ নিয়ে সেই সময়ই প্রতিবাদ করেন শিক্ষার্থীরা। পালন করেন প্রতিবাদী বিভিন্ন কর্মসূচিও।

তারা আরো বলেন, ফ্যাসিবাদ বিদায় হয়েছে। কিন্তু ফ্যাসিবাদীদের রেখে যাওয়া নীতি নিজেদের মতো করে কায়েম করছে বর্তমান প্রশাসন। ফারজানা ইসলামের তৈরি করা অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে এক ডজনের বেশি কর্মসূচি করা হয়েছে। সেই অধ্যাদেশের বিধি এবার বর্তমান প্রশাসন প্রচার করছে। অর্থাৎ ফ্যাসিবাদ পালালেও নিয়ম রয়ে গেছে, তা বাস্তবায়িত হচ্ছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের যুগ্ম-সদস্য সচিব ও হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ফারহানা বিনতে জিগার ফেসবুকে লিখেছেন, “বঙ্গমাতা হলের প্রবেশিকার সঙ্গে বড় করে রাত ১০টার হলে ফেরার নির্দেশ, ভোর ৫ টা আগে অনুমতি ছাড়া বের না হওয়ার ফারজানা ভিসির আমলের আলাপ। আমি এখানে কোনো নির্দিষ্ট দল বা মতাদর্শকে না দেখে যদি হল প্রশাসনের গতানুগতিক আলাপ হিসাবেও দেখি, তাও বলব এভাবে দেওয়াটা জাহাঙ্গীরনগরের মত সেফ হ্যাভেনে মানায় না। এই আলাপটা না দিলেও হত, যেহেতু আশেপাশে সবাই উন্মুখ হয়ে আছে একটা খুঁত ধরতে।”

আবার বিধিমালা প্রচারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন কেউ কেউ। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী অলি উল্লাহ ফেসবুকে লিখেছেন, “বিশ্ববিদ্যালয় শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ সম্পর্কে নবীনদের জানানো প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব। মানা বা না মানা শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত বিষয়। এজন্য প্রাধ্যক্ষকে ধন্যবাদ।”

বিতর্কের বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদের (জাকসু) সাধারণ সম্পাদক মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, “২০১৮ সালে প্রণীত শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ নিয়ে জাকসু অবগত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জাকসুর পূর্ণাঙ্গ বডিতে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমরা কোনো নিবর্তনমূলক আইনের পক্ষপাতী নই। জাকসু সর্বদা শিক্ষার্থীদের অধিকার ও স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও তা অটলভাবে পালন করবে।”

১৫ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ ও সহকারী প্রক্টর সহকারী অধ্যাপক শামীমা নাসরিন জলি জানান, শৃঙ্খলা বিধি বিতরণের উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদের শুরু থেকেই নিয়ম-কানুন সম্পর্কে অবহিত করা।

তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীরা অপরাধ করলে অনেক সময় জানেই না, তারা কোন ধারা ভঙ্গ করেছে। বিধি সম্পর্কে ধারণা থাকলে অপরাধপ্রবণতা কমবে। সেই জায়গা থেকে আমি নবীনদের মধ্যে এটি বিতরণ করেছি। প্রশাসনের অনেকেই এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।”

তিনি আরো বলেন, “শৃঙ্খলা অধ্যাদেশে কেবল রাত ১০টার নিয়ম নয়, র‍্যাগিং, মাদকদ্রব্য সেবন, অভিভাবক থাকা, হল ছাড়ার সময়সহ নানা বিষয় রয়েছে। সচেতন শিক্ষার্থীদের এসব জানা জরুরি। আমি ব্যক্তিগতভাবে হিজাব পরিধান করি বলে কেউ কেউ এটি সান্ধ্য আইন বলে আখ্যা দিচ্ছেন। অথচ আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে কোনো শিক্ষার্থীর স্বাধীন চলাচলে বাধা প্রদানের ঘটনা ঘটেনি।”

অধ্যাপক শামীমা নাসরিন বলেন, “এই অধ্যাদেশ প্রণীত হয়েছিল তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সময়। তিনি নিজেও প্রগতিশীল ছিলেন। ‘সান্ধ্য আইন’ তিনি নিজেই প্রণয়ন করেছেন। যদি কোনো ধারা শিক্ষার্থীদের না-পছন্দ হয়, তবে তার দায় সেই সময়কার প্রশাসনের। আমি মূলত শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করার জন্যই এই বিধিমালাটি বিতরণ করেছি।”

শৃঙ্খলা অধ্যাদেশ সংশোধন বা পরিমার্জন বিষয়ে জানতে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সোহেল আহমেদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।