আকস্মিক দুর্ঘটনায় একই দিনে মারা যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) দুই মেধাবী শিক্ষার্থী। তাদের অকাল মৃত্যুতে শোকাভিভূত হয়ে পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসজুড়ে নেমে এসেছে গভীর শোকের ছায়া।
ওই শিক্ষার্থীরা হলেন, সোহান আল মাফি ও দেবপ্রিয় সুপ্ত। সোহান বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও চবি আবৃত্তি মঞ্চের সাবেক সভাপতি ছিলেন। তিনি বর্তমানে ঢাকার একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় (এনজিও) কর্মরত ছিলেন বলে জানা গেছে। ঢাকার মিরপুরে তিনি পরিবারের সঙ্গে থাকতেন।
অন্যদিকে, দেবপ্রিয় ব্যাংকিং অ্যান্ড ইস্যুরেন্স বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তার বাড়ি টাঙ্গাইল জেলায়।
জানা গেছে, সোহান ও তার বন্ধু শাকিল শুক্রবার (২ অক্টোবর) সকালে ঢাকা থেকে লামার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের মিনঝিরি সাদা পাথর এলাকায় অবস্থিত হোয়াইট পিক স্টেশন রিসোর্টে ওঠেন। পরে দুপুর দেড়টার দিকে তারা রিসোর্টের পাশের মাতামুহুরি নদীতে গোসলে নামেন। এ সময় শাকিল কূলে উঠতে পারলেও প্রবল স্রোতের টানে তলিয়ে যান সোহান।
এদিন নদীতে সোহানকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরদিন শুক্রবার বেলা ১১টায় মাতামুহুরি নদী থেকে সোহানের লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন।
ফায়ার সার্ভিস লামা স্টেশনের সাব অফিসার মো. আব্দুল্লাহ বলেন, “মাতামুহুরি নদী থেকে পর্যটক সোহানের লাশ শুক্রবার ১১টায় উদ্ধার করা হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়া শেষে তার লাশ পরিবারকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।”
এদিকে, দেবপ্রিয় সুপ্ত দুর্গাপূজোর বন্ধে নানাবাড়ি বেড়াতে যান। সেখানে শুক্রবার (৩ অক্টোবর) পূজা শেষ করে ফেরার পথে অসুস্থতা অনুভব করায় প্রথমে তাকে মানিকগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে অবস্থার অবনতি হওয়ায় শুক্রবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সুপ্ত সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ধারণা করা হচ্ছে, ফুড পয়জনিংয়ে আক্রান্ত হয়ে মারা যান সুপ্ত।
সোহানকে ঘিরে ভালোলাগার স্মৃতি ফেসবুকে তুলে ধরেছেন তারই লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক শিক্ষক কায়সার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি লিখেছেন, “শিক্ষকদের কিছু প্রিয় শিক্ষার্থী থাকে। সোহান ছিল আমার এ রকম একজন ছাত্র। সামনের বেঞ্চেই বসতো। নিয়মিত ক্লাস করত ভদ্র ছেলেটা। সহশিক্ষা কার্যক্রমেও ছিল সমান পারদর্শী। ক্যাম্পাসে আবৃত্তি নিয়ে কাজ করত। এমন একটা শিক্ষার্থীকে হারিয়ে ফেললাম চিরতরে।”
লোকপ্রশাসন বিভাগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন আহমদ বলেন, “সোহান আমাদের বিভাগ থেকে গেল বছরে স্নাতকোত্তর সম্পূর্ণ করে বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক এনজিওতে কর্মরত ছিল। তার আকস্মিক মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। সোহান বিভাগে একজন ভালো ও নিয়মিত শিক্ষার্থী ছিল। সবসময় ক্লাসের প্রথম বেঞ্চে বসতো। তার জানাযা সম্পন্ন হয়েছে। আমরা তার পরকালীন মঙ্গল কামনা করছি।”
ব্যাংকিং অ্যান্ড ইস্যুরেন্স বিভাগের সভাপতি মো. আবু বকর বক্কর সিদ্দিক বলেন, “পূজার কার্যক্রম শেষ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে তাকে মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে অবস্থার আরো অবনতি হওয়ায় তাকে ঢামেকে নেওয়া হয়। সেখানে দুপুরের দিকে সুপ্ত মারা গেছে।”
তিনি বলেন, “ফুড পয়জনিংয়ে আক্রান্ত হয়ে সে মারা গেছে বলে আমাদের ধারণা। আমাদের বিভাগের ১২ জন শিক্ষার্থী গতকালই (শুক্রবার) সেখানে গেছেন। এখনো তারা সেখানে আছেন। সুপ্তের মৃতদেহ সৎকার করা হয়েছে।”
সুপ্তের স্মৃতিচারণে করে তিনি বলেন, “সে পড়াশোনাসহ সবকিছুতে ভালো একজন ছাত্র ছিল। সে ভালো গান গাইত। বিশেষ করে বিভাগের বিভিন্ন প্রোগ্রামে সুপ্ত নিয়মিত অংশ নিত। একজন সংস্কৃতিবান শিক্ষার্থী ছিল সে। গত ২৫ সেপ্টেম্বরও সে ক্লাস করেছিল।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. সাইদুল ইসলাম শামীম বলেন, “একইদিনে দুই চবিয়ানের অকাল মৃত্যু মেনে নেওয়া খুব কষ্টকর। গত দেড় বছরে জুলাই আন্দোলন, আত্মহত্যা, অসুস্থতা ও সড়ক দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন কারণে আমাদের প্রায় ১২-১৩ জন ভাই-বোন মারা গেছেন। জাতিকে পথ দেখাবার অগ্রনায়কদের এরকম মৃত্যুতে আমরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. হোসেন শহীদ সরওয়ার্দী বলেন, “চবির এ দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর অপূরণীয় ক্ষতি কখনো পূরণ হবার নয়। যেকোনো মৃত্যুই আমাদের ব্যথিত করে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যেখানে তারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভূমিকা রাখবে, সেখানে তাদের অকালে ঝরে যাওয়াটা আমাদের ভারাক্রান্ত করে তুলে। আমরা এ দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত ও তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।”