ভোরের আলো ফুটতেই পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের জলরাশির নীরবে বয়ে চলা দেখা যায়। কিন্তু, এই নীরবতার গভীরে লুকিয়ে আছে একাত্তরের আর্তনাদ, হাহাকার আর অগণিত নিভে যাওয়া প্রাণের ইতিহাস। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পাশ দিয়ে প্রবাহিত এই নদীর তীর এক সময় ছিল পাক হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের নীরব সাক্ষী। মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে এখানে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। কারণ তাদের অপরাধ ছিল, তারা চেয়েছিল স্বাধীনতা, তারা হতে চেয়েছিল মুক্ত।
এই রক্তাক্ত ইতিহাসের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে আজও মাথা উঁচু করে আছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্বদ্যিালয় (বাকৃবি)। শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, বরং একটি সংগ্রামী জনপদ হিসেবে; যেখানে শিক্ষা আর দেশপ্রেম একে অপরের পরিপূরক।
বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাসে বাকৃবির ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ছয় দফা আন্দোলন, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা এবং ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান—প্রতিটি আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বাকৃবি ছিল বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের এক বলিষ্ঠ কেন্দ্র।
এখানকার ছাত্রসমাজ শুধু শ্রেণিকক্ষে সীমাবদ্ধ থাকেনি। রাজপথে নেমে তারা উচ্চারণ করেছে প্রতিবাদের ভাষা। শিক্ষকরা হয়েছেন পথপ্রদর্শক, আর কর্মচারীরা হয়েছেন নীরব সংগঠক। সেই ধারাবাহিক সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি আসে ১৯৭১ সালে।
১৯৭১: অস্তিত্বের লড়াইয়ে বাকৃবি
১৯৬১ সালে পূর্ব পাকিস্তান ভেটেরিনারি কলেজ থেকে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি রূপ নেয় পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সময়ের প্রবাহে এটি হয়ে ওঠে পূর্ব বাংলার কৃষি শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। ভোরের আলোয় উত্তাল ক্যাম্পাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি ভবন প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. কিউ. এম. ফজলুর রহিম দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা দেন—“আজ থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হবে স্বাধীন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।”
এই ঘোষণার মধ্য দিয়েই যেন বাকৃবির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। মুহূর্তেই ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বুঝে যান; এ লড়াই শুধু শিক্ষার নয়, এ লড়াই অস্তিত্বের, স্বাধীনতার।
ঘোষণার পরপরই বিপুলসংখ্যক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। কেউ অস্ত্র হাতে সম্মুখযুদ্ধে যান, কেউ সংগঠক হিসেবে কাজ করেন, কেউ বা মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়, খাবার ও তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন।
কিন্তু, এর মূল্য দিতে হয় ভয়াবহভাবে। রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সহযোগিতায় পাক হানাদার বাহিনী বাকৃবি ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় চালায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা। শিক্ষকদের মধ্যে শহীদ হন সহকারী অধ্যাপক এ. বি. এম. আশরাফুল ইসলাম ভূঁইয়া। কর্মচারীদের মধ্যে শহীদ হন মো. আক্কাছ আলী, মধুসূদন বর্মন, মো. নুরুল হক, মো. গাজী ওয়াহিদুজ্জামান, মো. হাসান আলী ও গিয়াস উদ্দিন; যাদের অবদান ইতিহাসের আড়ালে থাকলেও ত্যাগ ছিল অনন্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংরক্ষিত ডায়েরিতে একজন শিক্ষকসহ ১৮ জন শহীদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। পাশাপাশি সংরক্ষিত রয়েছে ৮৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম—যাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক উপাচার্য, খ্যাতনামা অধ্যাপক ও তৎকালীন ছাত্রনেতারা।
শিক্ষার্থীদের মধ্যেও বহু তরুণ প্রাণ ঝরে যায়। মৎস্য বিজ্ঞান, কৃষি প্রকৌশল, কৃষি, ভেটেরিনারি ও কৃষি অর্থনীতি অনুষদের একাধিক শিক্ষার্থী শহীদ হন; যারা ভবিষ্যতে জাতির সম্পদ হওয়ার কথা ছিল।
শহীদ শিক্ষার্থীদের স্মরণে বাকৃবিতে নির্মিত হয়েছে তিনটি আবাসিক হল; শহীদ জামাল হোসেন হল, শহীদ নাজমুল আহসান হল এবং শহীদ শামসুল হক হল। এই হলগুলোর দেয়াল যেন প্রতিদিন নতুন প্রজন্মকে বলে দেয়, তোমাদের আবাসের ভিত্তি গড়া হয়েছে রক্ত আর আত্মত্যাগের ওপর।
শহীদদের আত্মত্যাগকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অম্লান করে রাখতেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গড়ে উঠেছে মরণ সাগর, বধ্যভূমি ও বিজয় ’৭১; যা ইতিহাসের জীবন্ত পাঠশালা।
মরণ সাগর সম্পূর্ণ প্রস্ফুটিত শাপলা ফুলের ভেতর থেকে উঠে আসা দুটি দৃঢ় হাত—এক হাতে রাইফেল, রাইফেলের অগ্রভাগে লাল-সবুজ পতাকা। এই ভাস্কর্য যেন ঘোষণা করে, স্বাধীনতা শান্তির পথে আসেনি, এসেছে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। দেয়ালে খোদাই করা রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া বাকৃবির ১৯ জন শহীদের নাম। লাল রঙের সিঁড়ি ও মেঝে প্রতীক হয়ে উঠেছে রক্তের সাগরের।
বাকৃবির ফাস্টগেট এলাকায় অবস্থিত বধ্যভূমিটি পাক হানাদার বাহিনীর পাশবিকতার এক ভয়াবহ সাক্ষ্য। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে এখানে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৯৩ সালে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পর থেকে এই স্থানটি দাঁড়িয়ে আছে নীরব প্রতিবাদ হিসেবে; যেখানে মানুষ কথা না বলে ইতিহাস অনুভব করে।
জয়নুল আবেদিন মিলনায়তনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ‘বিজয় ’৭১’ ভাস্কর্যটি মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক রূপক। রাইফেল হাতে ছাত্র, পাশে দৃঢ় নারীর উপস্থিতি, পতাকা হাতে কৃষক; সব মিলিয়ে এটি বলে দেয়, স্বাধীনতা এসেছে সম্মিলিত শক্তিতে।
এই ভাস্কর্য সম্পর্কে অনুভূতি প্রকাশ করে শিক্ষার্থী মেহেরাজ হোসেন ইমন বলেন, “আমরা নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। কিন্তু, ‘বিজয় ’৭১’-এর দিকে তাকালেই মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের কথা মনে পড়ে। রাইফেল হাতে তেজোদীপ্ত ছাত্রকে দেখে মনে হয়; আমি তরুণ, আমি ছাত্র, দেশের সেবার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করাই আমার দায়িত্ব।”
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া বলেন, “মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির অস্তিত্ব, মর্যাদা ও আত্মপরিচয়ের চূড়ান্ত ভিত্তি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু কৃষি শিক্ষা ও গবেষণার সূতিকাগার নয়, বরং স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধিকার আন্দোলনের এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের ধারক।”
তিনি আরও বলেন, “মরণ সাগর, বধ্যভূমি ও ‘বিজয় ’৭১’ নিছক স্থাপনা নয়—এগুলো শহীদদের রক্তে রচিত ইতিহাস, ত্যাগের ভাষ্য এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জীবন্ত দলিল।”