২০২৫ সাল নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) জন্য ছিল ঘটনাবহুল, সংবেদনশীল ও দিক-নির্দেশনামূলক একটি বছর। একদিকে প্রশাসনিক শুদ্ধাচার ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় কঠোর সিদ্ধান্ত, অন্যদিকে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, গবেষণায় স্বীকৃতি ও আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে অভিষেক। সব মিলিয়ে বছরটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
শৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক কঠোরতা
বছরজুড়ে প্রশাসন শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে দৃশ্যমান কঠোরতা দেখায়। বিভিন্ন অভিযোগ ও তদন্তের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন মেয়াদে মোট ১০ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে সাময়িক বরখাস্ত, স্থায়ী বহিষ্কার ও একাডেমিক-প্রশাসনিক কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল রিসার্চ সেলে প্রায় ৪৩ লাখ টাকার আর্থিক কেলেঙ্কারি। শিক্ষকদের গবেষণা প্রকল্পের ভ্যাট ও ট্যাক্সের অর্থ যথা সময়ে সরকারি কোষাগারে জমা না দেওয়া, অর্থ আত্মসাৎ ও হিসাব গরমিলের প্রমাণ পাওয়ায় রিসার্চ সেলের কম্পিউটার অপারেটর কাওসার হামিদ চৌধুরী জিকুকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়।
শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা
মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী পরিচালক জিয়াউর রহমান ভুঁইয়াকে বিনা অনুমতিতে দীর্ঘদিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিষ্টাচার বহির্ভূত মন্তব্যের অভিযোগে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়। একই বছরে আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বাদশা মিয়ার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীর সঙ্গে অসদাচরণ ও একাধিক অভিযোগের প্রেক্ষিতে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। নারী শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানির অভিযোগে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান চাকরিচ্যুত হন এবং বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেন দুই বছরের জন্য সাময়িক বরখাস্ত হন। সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় আরো ৬জন শিক্ষককে একযোগে কার্যক্রম থেকে বিরত রাখে প্রশাসন।
নিরাপত্তা সংকট ও সহিংসতা
নিরাপত্তা পরিস্থিতিও ২০২৫ সালে নোবিপ্রবির জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থী বহনকারী দুটি বিআরটিসি বাসে গভীর রাতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ক্যাম্পাসজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। একই বছরের বিভিন্ন সময়ে নোবিপ্রবি শিক্ষার্থী ও বাসে একাধিক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে, যেখানে শিক্ষার্থীরা আহত হন এবং মামলা দায়ের হয়। এ ধরনের ঘটনা শিক্ষার্থীদের আতঙ্ক, অভিভাবকদের উদ্বেগ ও ক্যাম্পাসজীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
পরিবহন ব্যবস্থায় অনিয়ম ও দুর্বলতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন পুল ঘিরেও বছরজুড়ে বিতর্ক তৈরি হয়। বাসচালক ও হেলপারের বিরুদ্ধে অভিনব কৌশলে জ্বালানি তেল চুরির ভিডিও প্রকাশ পেলে পরিবহন ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও তদারকি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। প্রশাসন তদন্তের আশ্বাস দিলেও ঘটনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতাকে সামনে নিয়ে আসে।
শোক ও মানবিক অধ্যায়
মানবিক দিক থেকে বছরটি ছিল বেদনাবিধুর। ডেঙ্গু ও জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী মুসলেহ শাফীর মৃত্যু বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারকে শোকাহত করে। ক্যান্সারে আক্রান্ত সাবেক শিক্ষার্থী পারভেজ বিন আহমেদ জনি এবং ফার্মেসি বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী ওমর ফারুকের মৃত্যু পুরো ক্যাম্পাসে গভীর শোকের ছায়া ফেলে। ফলিত গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী ফাহিমা সুলতানা মারিয়ার আত্মহত্যা নতুন করে আলোচনার জন্ম দেয়। একই সঙ্গে ক্যান্সারে আক্রান্ত শিক্ষার্থী মশিউর রহমান ও সানজিদা সুলতানা মীমের চিকিৎসায় সহপাঠী ও শিক্ষকদের মানবিক উদ্যোগ নোবিপ্রবির সামাজিক দায়বদ্ধতার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।
উন্নয়ন ও অবকাঠামোয় বড় অগ্রগতি
সব সংকটের মাঝেও উন্নয়ন ও অর্জনে থেমে থাকেনি নোবিপ্রবি। বছরের শেষ দিকে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নে ৩৩৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেয়। এর আওতায় দীর্ঘদিন ধরে স্থবির থাকা একাডেমিক ভবন-৩ এর নির্মাণ পুনরায় শুরু, আধুনিক গবেষণা যন্ত্রপাতি ক্রয়, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি আধুনিকায়ন, বিদ্যুৎ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণের পাশাপাশি ক্লাসরুম সঙ্কট, ল্যাব সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথ দেখছেন শিক্ষার্থীরা।
আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে ঐতিহাসিক অর্জন
২০২৫ সাল নোবিপ্রবির জন্য সবচেয়ে গৌরবের মুহূর্ত নিয়ে আসে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। প্রতিষ্ঠার পর প্রথমবারের মতো টাইমস হায়ার এডুকেশন (THE) বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিংয়ে নোবিপ্রবি ১২০১-১৫০০ ব্যান্ডে স্থান লাভ করে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এর অবস্থান হয় ১২তম এবং গবেষণার মানদণ্ডে বিশ্বে ৭২২তম। পাশাপাশি THE ইন্টারডিসিপ্লিনারি সায়েন্স র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশে সপ্তম স্থান অর্জন করে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
গবেষণা ও একাডেমিক সাফল্য
গবেষণার ক্ষেত্রেও বছরটি ছিল সফল। ইউজিসি ও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত হিট(HEAT) প্রকল্পে নোবিপ্রবি দেশের সেরা দশ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় জায়গা করে নেয়। পাঁচটি বিভাগের সাতটি গবেষণা প্রকল্প অনুমোদিত হয়, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সক্ষমতা ও গ্রহণযোগ্যতাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। একই বছরে রিসার্চ ফেয়ার ও একাডেমিক এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গবেষণা ও শিক্ষায় অবদানের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। নারী গবেষকদের উৎসাহ দিতে বেস্ট উইমেন রিসার্চার অ্যাওয়ার্ড চালুর ঘোষণাও আসে।
নীতিমালা ও নামকরণে পরিবর্তন
২০২৫ সালে নীতিগত সংস্কারেও পরিবর্তন আসে। শিক্ষক নিয়োগে একাডেমিক দক্ষতা ও গবেষণা অর্জনের গুরুত্ব বাড়ানো হয়। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবন, হল ও স্থাপনার নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়, যা প্রশাসনিক সংস্কারের অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নোবিপ্রবি বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস অডিটোরিয়ামের নাম বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মোহাম্মদ রুহুল আমিন অডিটোরিয়াম, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির বঙ্গবন্ধু কর্নারের নাম বাংলাদেশ কর্নার, দেশরত্ন শেখ হাসিনা সমুদ্র বিজ্ঞান ও সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট স্থাপন শীর্ষক প্রকল্পের নাম সমুদ্র বিজ্ঞান ও সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট স্থাপন শীর্ষক প্রকল্প, মেডিকেল সেন্টারের নাম শহীদ মুগ্ধ মেডিকেল সেন্টার, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলের নাম নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী হল, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের নাম জুলাই শহীদ স্মৃতি ছাত্রী হল নামে নামকরণ করা হয়েছে।
একটি ঘটনাবহুল বছরের উপসংহার
২০২৫ সাল নোবিপ্রবির ইতিহাসে একই সঙ্গে কঠিন ও গৌরবময়। শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও মানবিক সংকটের পাশাপাশি বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে অভিষেক, শত কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প ও গবেষণায় সাফল্য বিশ্ববিদ্যালয়টিকে নতুন এক অধ্যায়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে।