অর্থনীতি

জানুয়ারি-ডিসেম্বর অর্থবছর করার সুপারিশ সাবেক গভর্নরের

দেশের উন্নয়ন প্রচেষ্টায় একটি বড় দুর্বলতা হিসেবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অপ্রতুল বাস্তবায়নকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। এর প্রতিকারে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর অর্থবছর করার সুপারিশ করেছেন তিনি।

বুধবার (১১ আগস্ট) ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই আয়োজিত ‘বঙ্গবন্ধুর অর্থিক দর্শন: শিল্প ও বাণিজ্য উন্নয়নে বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তিনি এ সুপারিশ করেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ।

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রচেষ্টায় একটি বড় দুর্বলতা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অপ্রতুল বাস্তবায়ন এবং বছরের শেষের দিকে তাড়াহুড়ার খরচ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির সংশোধিত বরাদ্দের মাত্র শতকরা ৬০ ভাগ বাস্তবায়িত হয়; আর মে-জুন মাসে খরচ হয় শতকরা ৪০ ভাগ। মে-জুনের বৃষ্টি আর বন্যার পানির নীচে আর নদী ভাঙন ও বাঁধের ফাটলে দেশের অর্থসম্পদের একটি অংশ তলিয়ে যায়, দেশের তেমন কোনো উপকার হয় না। অনাচার রোধে জানুয়ারি-ডিসেম্বর অর্থবছর করার জোর সুপারিশ পুনরায় পেশ করছি।

সেমিনারে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ, কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ, শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন অংশ নেন। এছাড়া বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠনের নেতারা এতে অংশ নেন। 

মূল প্রবন্ধের শেষ অংশে বর্তমান ভবিষ্যতের হালচাল ও করণীয় অংশে ড. ফরাসউদ্দিন বলেন, করোনার কষাঘাতে অর্থনীতি বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রাক্কলিত বার্ষিক সমষ্টিক আয় প্রবৃদ্ধি ৮১ শতাংশ ছিল-অর্জন ৩.৫১ শতাংশ। অনুরূপভাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে মূল প্রাক্কলন ৮.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি সংশোধন করে ৫.৪৭ শতাংশে হাস করা হয়েছে; এটিও অর্জিত হয়েছে কিনা সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

বর্তমান বছরের ২০১-২২ বাজেটে বার্ষিক সমষ্টিক আয়ের প্রবৃদ্ধি শতকরা ৭.২ হবে বলে যে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে তা অর্জনের আশা করা খুবই বান্ধবসম্মত নয়। মার্কিন অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি শুরু হয়েও থেমে যাচ্ছে। ইউরোপীয় সম্প্রসারণও করোনায় আবারও হুমকির সম্মুখীন।

ভারতের অবস্থাও তেমন ভালো নেই।  তবু দেশটি তৈরি পোষাকে পুঁজি প্রত্যাহার লছে- এর সিংহভাগ দেশান্তর হচ্ছে ভিয়েতনামে। ভিয়েতনাম , কম্বোডিয়া ও মালয়েশিয়া তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বেশ ভালোভাবে অগ্রসরমান; উৎপাদনশীলতার অগ্রসরতা এবং ব্যবস্থাপনার মুন্সীয়ানার এ অর্জনের দাবিদার।

বিশ্বব্যাংক বলছে সম্ভশ্রমে নিম্ন আয়ের জন্য কম মূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বেশিদূর যাওয়া যাবে না। ডিজাইন ও গন্তব্য বহুমুখীকরণ ছাড়া পোষাক রপ্তানি টেকসই হবে না। বিদেশি  বিনিয়োগও প্রয়োজন।

অর্থনীতির এই বিশ্লেষক বলেন, আমাদের রপ্তানি বাড়ছে না, আমদানি স্থিতিশীল তবে ভোগ্যপণ্য আমদানি বাড়ছে। রেমিট্যান্স প্রবাহে কমে যাওয়া শুরু হয়েছে। করোনার আঘাত থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য যে সাহসী ও বিপুল প্রণোদনা প্যাকেজ সরকার ঘোষণা করেছেন, শুরু থেকেই তার যে অংশটি কুটির, অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র শিল্পের পুনরুত্থান ঘটানোর কথা তার সিংহভাগ অব্যবহৃত থাকছে। 

এ ব্যাপারে সরকার ও শিল্প বণিক সমিতিসমূহ যৌথভাবে সমীক্ষা করে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় কুটির, অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র শিল্পের ধারাটিকে দ্বিগুণ আলোয় প্রজ্জ্বলিত করতে পারেন।  এ ক্ষেত্রে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল এর সহায়তা কাজে আসবে।

ফরাউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রাপথে সবচেয়ে লজ্জার জায়গা হলো- পৃথিবীর প্রায় সর্বনিম্ন ট্যাক্স জিডিপি অনুপাত (শতকরা দশ ভাগের নীচে এবং প্রবণতা নিম্নগামী)। বস্টন কনসাল্টি গ্রুপ ও মাস্টার কার্ড ২০১৬ সনেই সমীক্ষা করে দেখিয়েছে যে বাংলাদেশে ২.৫ কোটি লোকের হাতে পাচ হাজার মার্কিন ডলারের মাথাপিছু আয় এবং ভোগ্যপণ্যে চাহিদা সম্পন্ন জনগোষ্ঠী রয়েছে।

অথচ কর আদায় করি মাত্র ২৫ লাখ দাতা অর্থাৎ করযোগ্য আয় অর্জনকারীর মাত্র শতকরা ১০ ভাগে কাছ থেকে। আর কর রাজস্ব আদায় করতে না পারলে বিনিয়োগে পাবলিক সেক্টর কিভাবে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি ব্যক্তি খাতের প্রসারে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

এ ব্যাপারে আপদকালীন অগ্রাধিকারে সম্মিলিত এবং আপস মিমাংসার মাধ্যমে কার্যকর কৌশল নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব এবং উচিত।  অর্থনীতির পুনরুত্থানে এবং জাতির পিতার দর্শন সোনার বাংলায় কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় এফবিসিসিআইসহ ব্যক্তিখাতের সব অংশীদার সরকারের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে সংস্কার এবং সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিতে হবে।