অর্থনীতি

‘শার্ট টু শিপ’ স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে...

বর্তমান সরকার দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত ও ত্বরান্বিত করতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে দেশ স্বল্প উন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে এবং তৎপরবর্তী মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হতে চলেছে। জাহাজ নির্মাণ শিল্পখাত অত্যন্ত উচ্চমূল্যের একক পণ্য উৎপাদন করে বিধায় আমাদের মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণের প্রধানতম সূচক হলো এই শিল্প খাত, যা সর্বশেষ ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা কর্মসূচিতেও উল্লেখ করা হয়েছে। 

অতীতে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হওয়া অনেক রাষ্ট্র এ ধরণের অগ্রগতি ধরে রাখতে পারেনি। ‘মধ‌্য আয়ের ফাঁদে’ পড়ে তাদের সার্বিক অর্থনীতি পূর্বের চাইতে আরো খারাপ অবস্থায় ফিরে গেছে। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকরা এ ব্যাপারে বেশ সচেতন। তাই সরকার একক রপ্তানি পণ্য অর্থাৎ রেডিমেড গার্মেন্টসের নির্ভর না থেকে বহুমুখী রপ্তানি পণ‌্য যেমন হাইটেক বা ভারী শিল্প ও হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের উপর জোর দিয়েছে। আর এর প্রতিফলন হিসেবে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা মহামারিকালেও সশরীরে উপস্থিত থেকে মন্ত্রিসভায় যুগান্তকারী ‘জাহাজ নির্মাণ শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা ২০২১’ অনুমোদন করেন। এছাড়া এর বাস্তবায়নের ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেন। 

ইতিপূর্বে এই জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে বিশ্বের স্বনামধন্য ও প্রতিষ্ঠিত জাহাজ নির্মাতা দেশ (যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চীন) অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি লাভ করেছে। এই নীতিমালায় জাহাজ নির্মাণ শিল্পের সম্ভাবনা, বিদ্যমান সমস্যাগুলোর উত্তরণ ও বিকাশ সাধনের ব্যাপক পরিকল্পনা প্রণীত হয়। এই নীতিমালার মিশন হলো ‘অধিক বিনিয়োগ ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ২০২৬ সালের মধ্যে জাহাজ রপ্তানি খাতের অবদান ৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নতকরণ’; যা ২০২২ সালে এসেই বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে। 

প্রচুর কার্যাদেশ প্রাপ্তির প্রেক্ষিতে এশীয় জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিগত ১০ বছরের মন্দাভাব কাটিয়ে এখন চাঙ্গাভাব দেখা দিয়েছে। 

উল্লেখ্য, ২০০৯-২০১০ সালের গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ক্রাইসিস এবং ইউরোজোন সংকট ২০১১/২০১২ এর প্রভাবে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন ভাড়া আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পায়। ফলশ্রুতিতে জাহাজমালিক ও অপারেটররা পরিচালন ব্যয় উঠে না আসায় জাহাজ পরিবহন খাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। আবার করোনা মহামারিকালে বিগত ২ বছরে বিশ্বের অধিকাংশ জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ছিল। ফলে কার্যত ২০০৮ সালের পর থেকে বিশ্বব্যাপী আর তেমন কোন জাহাজ নির্মিত হয়নি। 

অপরদিকে এরই মধ্যে বিশ্বের প্রায় ৫৫ শতাংশ জাহাজই ২০ বছরের বেশি পুরনো হওয়ায় মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়ে, যা অচিরেই বিশ্বের জাহাজবহর হতে বিদায় নিতে যাচ্ছে। ফলে বিশ্বব্যাপী নতুন জাহাজের চাহিদা প্রকট আকার ধারণ করে। একই সাথে বর্তমানে জাহাজের পণ্য পরিবহন ভাড়া প্রায় ৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে জাহাজমালিকরা নতুন জাহাজ সংগ্রহে এখন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি চাহিদা রয়েছে ছোট ও মাঝারি আকারের জাহাজের, যা তৈরিতে বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যে মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছে এবং বিশ্বে সুনাম অর্জন করেছে। 

বর্তমান বিশ্বে এই ছোট ও মাঝারী আকারের জাহাজের প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলারের বাজার রয়েছে। বাংলাদেশ যদি এর ১ শতাংশ কার্যাদেশ/রপ্তানিদেশও পায় তবে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ৪ বিলিয়ন ডলার। মালিকরা এখন বিশ্বব্যাপী জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে জাহাজ নির্মাণে নিবিড় যোগাযোগ শুরু করেছে। 

চাইনিজ অ্যাসোসিয়েশন ফর দ‌্য ন্যাশনাল শিপবিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রি’র (সিএএনএসআই) বরাতে জানা যায়, চীনা জাহাজ নির্মাতাদের ইতোমধ্যে নতুন জাহাজ নির্মাণাদেশ ৯০.০০ মিলিয়ন ডিডব্লিউটি ছাড়িয়ে গেছে।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলেছে, গ্লোবাল শিপইয়ার্ডগুলো, যা এক বছর সময় আগেও একটি সংকটাপন্ন অবস্থায় ছিল তারা এখন নতুন কার্যাদেশ প্রাপ্তিতে সমৃদ্ধ হচ্ছে।

বন্ধ থাকা কোরিয়ান শিপইয়ার্ডগুলোও এখন পুরোদমে জাহাজ নির্মাণ কার্যক্রম শুরু করেছে। বিশ্বব্যাপী মহামারি চলাকালে হোম অর্ডারের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় চীন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে পণ‌্য পরিবহন ভাড়া বেড়ে প্রায় ৭০০০ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ফলে শীর্ষস্থানীয় শিপিং প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। এর ফলে বিশ্বব্যাপী জাহাজ নির্মাণের বাজার, বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি এবং পরিবেশ বান্ধব জাহাজের চাহিদা ২০২৬ সাল নাগাদ ১৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। 

কাজেই আমাদের সামনে এখন বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হাতছানি। কিন্তু আমাদের আন্তর্জাতিক মানের কর্মদক্ষ জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় এ সুযোগ দু‘হাত ভরে নিতে পারছে না। বিশ্বের অন্যান্য প্রতিযোগী দেশগুলো (চীন, কোরিয়া, জাপান, ভারত, ভিয়েতনাম) এক্ষেত্রে অনেকাংশ এগিয়ে রয়েছে। 

রপ্তানি জাহাজ তৈরি খরচ বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশে জাহাজ তৈরির অতিরিক্ত আর্থিক খরচ অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের তুলনায় অনেক বেশি। উপরন্তু, ঐ সকল দেশসমূহ তাদের সরকারের কাছ থেকে ব্যাপক নগদ ভর্তুকি পেয়ে থাকে। ফলে শুধুমাত্র কম শ্রম খরচ দিয়ে বাংলাদেশ এ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না। সুতরাং সরকারকেই এ ক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। জরুরিভাবে ‘জাহাজ নির্মাণ উন্নয়ন শিল্প নীতিমালা- ২০২১’ এর সফল বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশীয় জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক অনুদান দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে ভরসা যোগাতে হবে যাতে করে তারা বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে প্রতিযোগিতা করে সর্বাধিক রপ্তানিদেশ পেতে পারে। তাহলে দেশের মোট রপ্তানি আয় দ্বিগুণ হতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। 

আর বর্তমান সরকারের নেওয়া ভিশন-২০২৫ এর সফল বাস্তবায়ন আগামী ১ থেকে ২ বছরের মধ্যে দৃষ্টিগোচর হবে। আমাদের জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো রপ্তানি ছাড়াও অত্যন্ত সাশ্রয়ী মূল্যে বিশ্বমানের টাগ, কন্টেইনার জাহাজ, কার্গো জাহাজ, রো-রো ফেরী, ফিশিং ট্রলার, ড্রেজার ইত্যাদি তৈরি করে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহ করছে। অথচ অতীতে এসকল জলযান বিদেশ থেকে প্রায় ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি মূল্যে আমদানি করতে হতো। ফলে সরকারের বিপুল আর্থিক সাশ্রয়ের পাশাপাশি আমদানিতব্য ব্যয় বাবদ মেটানো বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করে দেশের অর্থনীতি তথা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধ করছে। 

এটি একটি শ্রমঘন শিল্প। এখানে অধিক বিনিয়োগ, উন্নত প্রযুক্তি ও দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হয়। বিশ্বের অন্যান্য জাহাজ নির্মাণকারী নেতৃস্থানীয় দেশের বিদ্যমান আর্থিক বিনিয়োগ কাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা ততটা উন্নত নয়। সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত করার রূপকল্প স্থির করে নৌ-পরিবহনসহ ব্যাপকভিত্তিক উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। দেশের জাহাজ নির্মাণকারী শিপইয়ার্ডগুলো সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের হেভি ইঞ্জিনিয়ারিং ও লজিস্টিক সাপোর্টে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ইতোমধ্যে ২০০৮ সাল হতে বাংলাদেশ জাহাজ রপ্তানি শুরু করে। বিগত কয়েক বছরে দেশের শিপইয়ার্ডগুলো ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার কয়েকটি দেশে ৪২টি জাহাজ রপ্তানি করে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার আয়ের মাধ্যমে দেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের ভাবমূর্তি উন্নয়নে অবদান রেখেছে। এছাড়া প্রায় ১ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। 

বিশ্বজুড়ে আমাদের জাহাজ নির্মাণের প্রচার ও উন্নয়নে সরকারের মনোযোগ দেয়ার এখনই যথার্থ সময়। কেননা এই শিল্প ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে উচ্চ প্রযুক্তির উৎপাদন সক্ষমতায় ব্র্যান্ডিং ও ইমেজ নির্মাণের একটি প্রধান হাতিয়ার হতে পারে, যা পরবর্তীতে বিশ্ববাজারে আমাদের ‘আলোচনার শক্তি’ বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। সরকার জাহাজ নির্মাণের মাধ্যমে রপ্তানি বৈচিত্র্যের উপর গুরুত্বারোপ করেছে। যাতে করে ‘শার্ট টু শিপ’কে কেন্দ্র করে দেশের রপ্তানি বাজারকে উন্নত ও প্রসারিত করা যায়। 

উল্লেখ্য, ২০২৬ সালের পর থেকে বাংলাদেশ পূর্বের ন্যায় (নিম্ন আয়ের দেশ হিসাবে] রপ্তানি খাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রবেশাধিকার আর পাবে না, তখন আমাদের শুধুমাত্র দেশের ভাবমূর্তি ও পণ্যের বিশেষ পরিচিতি অর্থাৎ ব্র‌্যান্ড নেম’কে পুঁজি করে প্রতিযোগিতামূলক হয়ে বিশ্ব রপ্তানি বাজারে টিকে থাকতে হবে।

বর্তমান সরকার সুনীল অর্থনীতির (ব্লু-ইকোনমি) উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সামুদ্রিক সম্পদ অন্বেষণ ও আহরণ এই অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য। উন্নত প্রযুক্তির ফিশিং ভেসেল ট্রলার) নির্মাণসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজে জাহাজ নির্মাণ শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করছে।

বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাতারা আগামী বছরগুলোতে উচ্চমূল্যের রপ্তানি আদেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে আগ্রহী, যা এই খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। এছাড়া সংযোগ শিল্পের জন্য আরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। কাজেই রপ্তানি আয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে বিপুল সম্ভাবনাময় এ শিল্পখাতকে অর্থনৈতিকভাবে চাঙ্গা ও সফলতার সঙ্গে এগিয়ে চলার ভরসা প্রদানের এখনই উপযুক্ত সময়।