অর্থনীতি

দেশের এয়ারলাইন্স ব্যবসা কে নিয়ন্ত্রণ করছে?

জেট ফুয়েলের মূল্য এক সঙ্গে ১৯ টাকা বৃদ্ধি, যা এয়ারলাইন্স ব্যবসায় ভাবনারও অতীত ছিলো। অথচ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়ম করপোরেশন তা বাস্তবে রূপ দিয়েছে। ঈদুল আজহার ছুটি শুরু হওয়ার আগ মূহূর্তে ৭ জুলাই শেষ কর্মদিবসের শেষ সময়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন এয়ারলাইন্সগুলোকে নির্দেশনা দেয় নতুন দামে জেট ফুয়েলের মূল্য পরিশোধ করার জন্য। যার কার্যক্রম শুরু হয় ৮ জুলাই শুক্রবার থেকে।

প্রতি মাসে রুটিন করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন জেট ফুয়েলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে অস্থির হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের এভিয়েশন ব্যবসা। করোনার সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত গত ২০ মাসে জেট ফুয়েলের মূল্য বৃদ্ধি পায় শতকরা ১৮৩ ভাগ। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জেট ফুয়েলের মূল্য ছিলো ৪৬ টাকা প্রতি লিটার। আর ২০২২ সালের জুলাই মাসে তা দাঁড়িয়েছে ১৩০ টাকা প্রতি লিটার। এভিয়েশন ব্যবসার ভবিষ্যত নিয়ে আতঙ্কিত সংশ্লিষ্টরা। ব্যবসার ভবিষ্যত নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে সময় পার করছেন বিনিয়োগকারীরা ।

গত ৭ জুলাই অভ্যন্তরীণ রুটে জেট ফুয়েলের মূল্য ১১১ টাকা থেকে ১৯ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৩০ টাকা। আর আন্তর্জাতিক রুটে প্রতি লিটার জেট ফুয়েলের মূল্য ১.০৯ ডলার থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১.২২ ডলার। গত ৫ মাসে জেট ফুয়েলের মূল্য বৃদ্ধি পায় প্রতি লিটারে ৫০ টাকা।

একটি দেশের আকাশ পথের গতিশীলতা তখনই বজায় থাকবে যখন দেশের এয়ারলাইন্সগুলো আকাশ পরিবহন ব্যবসায় সঠিক কক্ষপথে বিচরণ করবে। সঠিক কক্ষপথে থাকার জন্যে এয়ারলাইন্সগুলোর পরিচালন ব্যয় হতে হবে যৌক্তিক ও আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশে এভিয়েশন ব্যবসায় এয়ারলাইন্সগুলো বিশেষ করে বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো গত সাতাশ বছর ধরে সঠিক কক্ষপথে বিচরণ করতে পারছে না। ৮ থেকে ৯টি বেসরকারি এয়ারলাইন্স নানা কারণে বাংলাদেশ এভিয়েশনে ইতিহাস হয়ে আছে। কিন্তু সর্বশেষ দু’টি এয়ারলাইন্স ইউএস-বাংলা ও নভোএয়ার সঠিক কক্ষপথে টিকে থাকার জন্য লড়াই করছে।   

বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলোকে প্রতিনিয়ত অসম প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে জাতীয় বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সাথে। এটাই স্বাভাবিক ধরে নিয়ে বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো ব্যবসায় টিকে থাকার চেষ্টা করছে। আরও দুটি এয়ারলাইন্স এয়ার এস্ট্রা ও ফ্লাই ঢাকা বাংলাদেশ এভিয়েশনে নতুন শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে।

এয়ারলাইন্সগুলো কি জেট ফুয়েলের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ভাড়া সমন্বয় করতে পারে? সেটি কি সম্ভব? জেট ফুয়েলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে যাত্রী ভাড়া বৃদ্ধি করলে যাত্রী সংখ্যার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যেকোনো রুটের অপারেশন খরচের ৪০ শতাংশই হচ্ছে জেট ফুয়েলের খরচ। এয়ারলাইন্স ব্যবসায় আয়-ব্যয়ের মধ্যে ব্যাপক তারতম্য দেখা যাচ্ছে। যখন আন্তর্জাতিক বাজারে জেট ফুয়েলের মূল্য বৃদ্ধি পায় তখন দেশীয় বাজারে জেট ফুয়েলের মূল্য বৃদ্ধি পায় আবার বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন তাদের পূর্বের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতেও অনেক সময় জেট ফুয়েলের দামের সমন্বয় করে থাকে যা সরাসরি এয়ারলাইন্স ব্যবসার ওপর প্রভাব পড়ে।

২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্বময় জেট ফুয়েলের ঊর্ধ্বগতির কারণে বাংলাদেশে তৎকালীন নবপ্রতিষ্ঠিত বেস্ট এয়ার, এভিয়ানা এয়ারওয়েজ যাত্রা শুরু করার কিছু দিনের মধ্যেই অপারেশন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছিলো। সেই সময়ে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ও জিএমজি এয়ারলাইন্সকেও চরম অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে হয়েছিলো। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় জেট ফুয়েলের অগ্নিমূল্য যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, এভিয়েশন খাত চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর এভিয়েশন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানো পর্যটন খাত মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হবে।

করোনাকালীন সময়ে সারা পৃথিবীর সব এয়ারলাইন্স চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রত্যেকটি দেশের সরকার কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এভিয়েশন ও ট্যুরিজমকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এয়ারলাইন্স ও ট্যুরিজম কোম্পানির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। নানা ধরনের প্রণোদনা, ভর্তুকি, চার্জ মওকুফসহ নানাবিধ কার্যক্রম দেখা গেছে। কিন্তু আমাদের দেশে উল্টোচিত্র চোখে পড়েছে। করোনা মহামারির সময়ে এয়ারলাইন্সগুলোর পক্ষ থেকে মাত্রাতিরিক্ত এ্যারোনোটিক্যাল ও নন-এ্যরোনোটিক্যাল চার্জ কমানোর অনুরোধ উপেক্ষা করা হয়েছে। দফায় দফায় জেট ফুয়েলের মূল্য বৃদ্ধি করে, এয়ারপোর্ট ডেভেল্পমেন্ট ফি, সিকিউরিটি চার্জ যুক্ত করে এভিয়েশন খাতকেই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।

জেট ফুয়েলের মূল্য যেমন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন নির্ধারণ করে তেমনি ডিজেল, কেরোসিন, অকটেন, পেট্রোল, এলপি গ্যাস ও ম্যারিন ফুয়েল ইত্যাদির মূল্যও নির্ধারণ করে। দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন এর ওয়েবসাইটে উল্লেখিত ডিজেল, কেরোসিন এর মূল্য সর্বশেষ নির্ধারণ করেছে ২০২১ সালের ৪ নভেম্বর আর অকটেন ও পেট্রোল ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল নির্ধারণ করা হয়েছিলো, এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ হয়েছিলো ১৭ মে ২০২১ এমনকি মেরিন ফুয়েল এর দাম নির্ধারণ করেছিলো ৭ এপ্রিল ২০২২ তারিখে। অথচ করোনাকালীন সময়ে জেট ফুয়েলের মূল্য সেপ্টেম্বর ২০২০ এর পরই নির্ধারণ হয়েছে ১৫ বারের অধিক, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।

সংশ্লিষ্ট সকলের বর্তমানকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করে ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত রাখতে জেট ফুয়েলের মূল্য নির্ধারণের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব জরুরি। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে মূল্য সমন্বয় করে এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিকে সচল রাখা। তা না হলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক রুটের মার্কেট শেয়ার বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর কাছে চলে যাবে। যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশে বিনিয়োগকারী এয়ারলাইন্সগুলো। ফলে জিডিপি-তে অংশীদারিত্ব কমে যাবে এভিয়েশন খাত থেকে। যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।

লেখক: মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ), ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স