অর্থনীতি

বছরজুড়ে বিএসইসির কার্যকরী পদক্ষেপে সংকট কাটিয়ে উঠছে পুঁজিবাজার

করোনা পরিস্থিতির মধ্যে ২০২০ সালের ১৭ মে পুঁজিবাজারের হাল ধরেন পুনর্গঠিত বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। কাজে যোগদানের পর থেকে নতুন কমিশনের নানামুখী কার্যকর উদ্যোগে গতিশীলতা পায় পুঁজিবাজার। আস্থা ফেরায় প্রাণ ফিরে পান বিনিয়োগকারীরা। তবে দেড় বছর ধারাবাহিক উত্থানের পর গত বছরের শেষের দিকে পুঁজিবাজারে শুরু হয় সংশোধন। তার সঙ্গে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে যুক্ত হয় ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধসহ নানান বৈশ্বিক সংকট। এর প্রভাব থেকে রক্ষা পায়নি দেশের পুঁজিবাজার।

তবে এ সংকট কাটিয়ে উঠতে শিবলী রুবাইয়াতের নেতৃত্বাধীন কমিশন নিয়েছে কার্যকরী নানামুখী পদক্ষেপ। এসব পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে বড় ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছে পুঁজিবাজার। এ সংকট সৃষ্টি না হলে দেশের পুঁজিবাজার আরও গতিশীল হতো বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারীসহ সংশ্লিষ্টরা।

গত বছরের শেষের দিতে নানা ইস্যুতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এবং আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে মত-ভিন্নতার প্রভাব ফেলে পুঁজিবাজারে। যার প্রভাব কয়েক মাস সংশোধন শেষে ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করে পুঁজিবাজার। তবে তা ধাক্কা খায় শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে। এরপর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শেষে ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নামে বিপর্যয়। যার প্রভাব পড়ে দেশের পুঁজিবাজারে। এ ছাড়া নানান ধরনের গুজবে আরও অস্থির হয়ে উঠে দেশের পুঁজিবাজার। এসব পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিএসইসি যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তা ইতিপূর্বে কখনোই নেওয়া হয়নি।

তাই এ পরিস্থিতিতে কমিশনসহ সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে টালমাটাল পরিস্থিতি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণেই বিশ্ব অর্থনীতিতে টালমাটাল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এ যুদ্ধ থামলেই আতঙ্ক কাটিয়ে গতিশীলতায় ফিরবে পুঁজিবাজার। তবে দ্বিতীয় দফায় ফ্লোর প্রাইস আরোপ করা না হলে সাধারণ বিনিয়োগকারী ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। শুধুমাত্র সাধারণ বিনিয়োগদের কথা ভেবে কমিশনকে ফ্লোর প্রাইস বহাল রেখেছে। এটা তুলে নিলে মার্জিন ঋণ নেওয়া বিনিয়োগকারীরা ফোর্স সেলের আওতায় পড়তো। তখন আরও বেশি বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হতো। 

গত এক বছরের ডিএসইর বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছরের ২ জানুয়ারি ডিএসই’র প্রধান ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৬ হাজার ৮৫৩.১৩ পয়েন্টে। আর ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএসইএক্স সূচক কমে অবস্থান করছে ৬ হাজার ২৫৬.৮২ পয়েন্টে। ফলে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ডিএসইএক্স সূচক কমেছে ৫৯৬.৩১ পয়েন্ট বা ৮.৭০ শতাংশ। তবে চলতি বছরের ২৮ আগস্ট ক্রমাগত দরপতনে ডিএসইএক্স সূচকটি ৫ হাজার ৯৮০.৫১ পয়েন্টে নেমে আসে। চলতি বছরের ২ জানুয়ারি ডিএসই’র শরিয়াহ সূচক ডিএসইএস সূচক ছিল ১ হাজার ৪৪৫.৩৭ পয়েন্টে। আর চলতি বছরের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএসইএস সূচক কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ৩৭২.৯৬ পয়েন্টে। ফলে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ডিএসইএস সূচক কমেছে ৭২.৪১ পয়েন্ট বা ৫ শতাংশ। এ ছাড়া চলতি বছরের ২ জানুয়ারি ডিএসই’র ডিএস৩০ সূচক ছিল ২ হাজার ৫৬০.৬৪ পয়েন্টে। আর চলতি বছরের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএস৩০ সূচক কমে অবস্থান করছে ২ হাজার ২০৮.৯৫ পয়েন্টে। ফলে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ডিএস৩০ সূচক বেড়েছে ৩৫২.১৭ পয়েন্ট বা ১৩.৭৫ শতাংশ।

এদিকে, চলতি বছরের ২ জানুয়ারি ডিএসই’র বাজার মূলধন ছিল ৫ লাখ ৪৭ হাজার ৯০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। আর চলতি বছরের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএসইর বাজার মূলধন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৬৩ হাজার ৭২৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা। ফলে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ডিএসই’র বাজার মূলধন বেড়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার ৬৩৬ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ২৮.৩৬ শতাংশ। তবে চলতি বছরের ১২ অক্টোবর ডিএসইর বাজার মূলধন বেড়ে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৭৪ হাজার ৬৬৯ কোটি ১১ লাখ টাকায়, যা পুঁজিবাজারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

তবে এই কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার সময় ডিএসইর ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৪ হাজারের নিচে। আর লেনদেন ছিল ১০০ কোটি টাকার নিচে। তাদের নেতৃত্বে ২০২১ সালের ডিএসইএক্স সূচক বেড়ে দাঁড়ায় ৭ হাজার ৩৬৭.৯৯ পয়েন্টে, যা এখনও পুঁজিবাজারের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

বছরজুড়ে বৈশ্বিক সংকটসহ বিভিন্ন ইস্যুতে অস্থির পুঁজিবাজারকে সামাল দিতে চলতি বছর বিএসইসির নেওয়া পদক্ষেপগুলো তুলে ধরা হলো-

চলতি বছরের মধ্যে বিএসইসির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো ফ্লো প্রাইস আরোপ। বৈশ্বিক সংকটের কারণে পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক পতন রোধে চলতি বছরের গত ২৮ জুলাই দ্বিতীয় দফায় ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে শেয়ারের দাম কমানো ঠেকিয়ে রাখার উদ্যোগ নেয় বিএসইসি। এ ধরনের পদ্ধতি পৃথিবীর অন্য কোনও দেশের পুঁজিবাজারে না থাকলেও দেশের সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বহাল রাখা হয়েছে।

সবার জন্য প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) শেয়ার নিশ্চিত করাও কমিশনের উল্লেখযোগ্য একটি পদক্ষেপ। এর আগে, লটারি করে আইপিওর শেয়ার বণ্টন করা হতো। তাতে হাতে গোনা কয়েকজন আইপিও পেতেন। এখন যারাই আইপিওর জন্য আবেদন করেন তারা সবাই তা পেয়ে থাকেন।

ব্যাংকের বিনিয়োগ-সীমার গণনা শেয়ারের বাজারমূল্যের বদলে ক্রয়মূল্যে নির্ধারণ করার দাবিও পূরণ করেছে বিএসইসি। বিনিয়োগকারীরা এক যুগ ধরে এ দাবিও করে আসছিল। এ দাবি পূরণ হওয়ার কারণে ব্যাংকের দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

বিভিন্ন কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা বেশ কিছু কোম্পানিতে প্রাণ ফিরেয়ে দিয়েছে কমিশন। ফলে কোম্পানিগুলো পুনরায় উৎপাদন শুরু হয়েছে। কিছু কোম্পানি পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করেছে। আর যেসব কোম্পানি পুঁজিবাজার থেকে টাকা তুলে লাপাত্তা হয়ে গিয়েছিল, সেগুলোকে ডি লিস্টিং করিয়ে বিনিয়োগকারীদের টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে বিএসইসি।

বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষে বেশ কিছু আইন-কানুন, বিধিবিধান সংস্কার করেছে বিএসইসি। কোম্পানিগুলোকে বোনাস লভ্যাংশের বদলে নগদ লভ্যাংশ দিতে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে।

পুঁজিবাজারে সাধারণ মানুষের সরকারি সিকিউরিটিজ লেনদেন স্বপ্ন করেছে বিএসইসি। এ কাজটি দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ও বিশাল অর্জন বলে মনে করে বিএসইসি। চলতি বছরের ১০ অক্টোবর থেকে পরীক্ষামূলকভাবে উভয় স্টক এক্সচেঞ্জে সরকারি সিকিউরিটিজের লেনদেন চালু হয়েছে।

মিউচুয়াল ফান্ডগুলোকে শৃঙ্খলায় আনতে কমিশনের উদ্যোগ দৃশ্যমান। ফান্ডগুলো নগদে গত দুই বছর দারুণ লভ্যাংশ দিয়েছে। ইউনিট দরের তুলনায় তাদের লভ্যাংশ যেকোনও সঞ্চয়ী আমানতের চেয়ে বেশি।

বন্ড মার্কেট উন্নয়নেও কমিশনের ভূমিকা রয়েছে। ইসলামি গ্রিন সুকুকের পাশাপাশি সরকারি ট্রেজারি বন্ডেরও লেনদেন শুরু হয়েছে, যা বিনিয়োগকারীকে নির্দিষ্ট অঙ্কের নগদ লভ্যাংশ নিশ্চিত করবে।

পুঁজিবাজারের উন্নয়ন, বাজারে শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা রক্ষার স্বার্থে বছরজুড়েই কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ছিল বিএসইসি। সিকিউরিটিজ আইন লঙ্ঘনের কারণে বিভিন্ন কারসাজি চক্রের সদস্যদের মোটা অঙ্কের জরিমানা ও পুঁজিবাজারে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে কমিশন।

এ ছাড়া বছরজুড়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিনিয়োগ শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখা, জাপানে ভার্চুয়ালি রোড শো আয়োজন করা, মার্কেট ইন্টারমিডিয়ারিদের কাজে উৎসাহ বাড়াতে স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তী পুরস্কার- ২০২২ প্রদান, বাজেটে পুঁজিবাজারে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগ পুনর্বহাল রাখা; এসএমই প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ সহজ করা, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জকে (সিএসই) কমোডিটি এক্সচেঞ্জ গঠনে সহায়তা, সিএসইর স্ট্রাটেজিক পার্টনার হিসেবে বসুন্ধরা গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এবিজিকে অনুমোদন, এক্সচেঞ্জ ট্রেডেট ফান্ড (ইটিএফ) ও অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড (এটিবি) গঠনে আইন প্রণয়ন, বিনিয়োগকারীদের প্রাপ্য লভ্যাংশ ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডের (সিএমএসএফ) মাধ্যমে ফেরত প্রদান, চেক জমা দিয়েই শেয়ার কেনার সুযোগ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পুঁজিবাজার নিয়ে গুজব বা ভীতি ছড়ানো কমাতে পদক্ষেপ গ্রহণ, ব্যাংক ও বিমা কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ, দেশের জনগণকে বিনিয়োগ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে মাধ্যমিক পর্যায় থেকে পাঠ্যপুস্তকে বিনিয়োগ শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ, শেয়ারহোল্ডারদের নগদ লভ্যাংশ প্রদানে উৎসাহিত করা ও বোনাস শেয়ার অনুমোদনের ক্ষেত্রে নীতিমালা পরিবর্তন করার পদক্ষেপ নিয়েছে বিএসইসি।

এদিকে, ফ্লোর প্রাইস বহাল রাখার কারণে স্তিমিত থাকা নতুন বিনিয়োগ পুঁজিবাজারে আনতে নগদ লভ্যাংশ বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিওত) অ্যাকাউন্টে আনার উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি। চলতি বছরের ডিসেম্বর মধ্যে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হতে পারে বলে জানা গেছে।

প্রসঙ্গত, ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অফ সিকিউরিটিজ কমিশনসের (আইওএসকো) এশিয়া প্যাসিফিক রিজিওনালের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে দায়িত্ব পালন করবেন। গত ১৭ অক্টোবর তিনি এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দেশের পুঁজিবাজারে এটাই প্রথম কোনও বড় অর্জন।