শিক্ষা

৬৬ বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় : প্রতিষ্ঠার কথা

প্রফেসর জি. এম. শফিউর রহমান : ছাত্র জীবনে অনেকেই হয়তো এমন একটি প্রশ্ন পড়েছেন যে, দেশের সবচেয়ে প্রাচীন সংগ্রহশালা বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর কোন প্রতিষ্ঠানের অধীনে? হ্যা, ১৯১০ সালে রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠিত বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরটি ১৯৬৪ সাল থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করে আসছে।

আজ ৬ জুলাই, প্রিয় মতিহারে প্রায় ৭৫৩ একর এলাকা জুড়ে অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা বাষির্কী। অনেক ইতিহাস ঐতিহ্য ও গৌরবগাথা নিয়ে ৬৬ বছরে পা দিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

বৃটিশ সরকারের আমলে ১৮৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজশাহী কলেজ। ঢাকা ও চট্টগ্রাম কলেজের পরেই এটা বাংলাদেশের তৃতীয় প্রাচীনতম কলেজ, যেখানে পড়াশোনা করেছেন উপমহাদেশের অনেক খ্যাতিমানরা। সেই সময় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রাজশাহী কলেজে আইন বিভাগসহ কিছু বিভাগে পোস্ট গ্রাজুয়েট শ্রেণি চালু হলেও অল্প কিছুদিন চলার পরই তা বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে রাজশাহীতে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য দাবি তোলেন সুশীল সমাজ। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তৎকালীন পাকিস্তান সরকার দেশের সব কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভূক্ত করার প্রক্রিয়া চালু করে। ফলশ্রুতিতে ১৯১৭ সালে গঠিত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন বা স্যাডলার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলন শুরু হয়।

 

১৯৫০ সালের ১৫ নভেম্বর রাজশাহীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ৬৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। রাজশাহীতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের দাবিতে প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫২ সালের ১০ জানুয়ারি রাজশাহীর ঐতিহাসিক ভুবন মোহন পার্কে।

১৯৫২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ভুবন মোহন পার্কে আবারও জনসভা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিকে তীব্র করা হয়, আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৫ ছাত্র নেতা কারাবন্দী হন। এই আন্দোলনের সাথে যোগ দিয়ে নতুন মাত্রা যোগ করেন পূর্ববঙ্গের আইন সভার সদস্য প্রখ্যাত আইনজীবী মাদার বখশ।

১৯৫২ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবির প্রেক্ষিতে নুরুল আমীন সরকার ১৯৫২ সালের নভেম্বর মাসে পূর্ব বাংলার ব্যবস্থাপক পরিষদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বিল উত্থাপন করেন। কিন্তু তৎকালীন সরকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি পূরণের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়নে তালবাহানা করতে থাকে।

 

ফলে, ১৯৫৩ সালে ৬ ফেব্রুয়ারি ভুবন মোহন পার্কের জনসভা থেকে সরকারকে হুঁশিয়ার করে বলেন, যদি রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা না হয়, তবে উত্তরবঙ্গকে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ দাবি করতে বাধ্য হবো। মাদার বখশের বক্তব্যে ব্যাপক সারা পড়ে জনমনে এবং সরকারেরও টনক নড়ে তাতে। অবশেষে ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ বিলটি  The Rajshahi University Act. 1953 (The East Bengal Act XV of 1953) নামে ব্যবস্থাপক পরিষদে পাশ হয়। ৬ জুন গভর্ণর এই বিলে সম্মতি প্রদান করেন  এবং ১৬ জুন ১৯৫৩ তারিখে একটি ঢাকা গেজেট এক্সট্রা অর্ডিনারিতে প্রকাশিত হয়। ৬ জুলাই, ১৯৫৩ তারিখে রাজশাহী কলেজের খ্যতনামা প্রাক্তন অধ্যক্ষ ডক্টর ইসরাত হোসেন জুবেরীকে প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য নিযুক্ত করা হয়। ঐদিন থেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। ড. জুবেরী ও মাদার বখশ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনার খসড়া প্রণয়ন করেন।

তখন পূর্ব বাংলার গভর্ণর ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। বর্তমানে ১৯৭৩ সালের প্রণীত বিশ্ববিদ্যালয় এ্যাক্ট দ্বারা ঢাকা, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মত পরিচালিত হচ্ছে। ১৯৭৩ এ্যাক্ট অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মহামান্য রাষ্ট্রপতি এ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ এবং উপাচার্য প্রফেসর ড. আব্দুস সোবহান। প্রফেসর ড. আব্দুস সোবহান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র উপাচার্য যিনি দুই বার উপাচার্য পদে নিযুক্ত হয়েছেন। গত বছর থেকে প্রথম বারের মত দুই জন উপ-উপাচার্য যথাক্রমে প্রফেসর ড. আনন্দ কুমার সাহা ও প্রফেসর ড. চৌধুরী মো. জাকারিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করছেন।

শুরুতে ১৬১ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়। প্রথমে দর্শন, ইতিহাস, বাংলা, ইংরেজী ও গণিতে পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্স চালু হয়। ক্লাসগুলো হতো রাজশাহী কলেজে। ঐতিহাসিক নীলকুটির উপর তলায় প্রতিষ্ঠা করা হয় উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের দপ্তর। ভোলানাথ বিশ্বেশ্বর হিন্দু একাডেমিতে চিকিৎসাকেন্দ্র ও পাঠাগার তৈরি করা হয়।

জমিদার কুঞ্জমোহন মৈত্রের বাড়িতে স্থাপন করা হয় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ দপ্তর। কলেজ পরিদর্শন দপ্তর স্থাপন করা হয় বড়কুটি পাড়ার মাতৃধামে। রাজশাহী কলেজ সংলগ্ন ফুলার হোস্টেলকে রুপান্তরিত করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস হিসাবে। ছাত্রী নিবাস করা হয় বড়কুটি এলাকার লালকুটি বভনে। ১৯৫৮ সালে বর্তমান ক্যাম্পাসে দালান কোটা ও রাস্তাঘাটা নির্মাণ শুরু হয়। অস্ট্রেলিয়ান স্থপতি বর্তমান ড. সোয়ানী টমাসের স্থাপত্য পরিকল্পনায় এই ক্যাম্পসটি গড়ে উঠে। মতিহারের এই ক্যাম্পাসে ১৯৬৪ সালের মধ্যে সকল অফিস বিভাগ চালু হয়। ড. শহীদ শামসুজ্জোহার রক্ত ভেজা এই ক্যাম্পাসে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান মালার মাধ্যমে পালিত হচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৬তম জন্মদিন।

লেখক

সভাপতি

ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স অ্যান্ড ইন্জিনিয়ারিং বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

 

রাইজিংবিডি/রাবি/৬ জুলাই ২০১৯/লাকী