শিক্ষা

টিএসসি মাতালেন ১৩ প্রতিবন্ধী

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা তখন ছয়টার কাছাকাছি। ঢাকা বিশাববিদ্যালয়ের টিএসসি সড়ক দ্বীপ। দ্বীপের মঞ্চে হুইল চেয়ারে বসে আছেন চার জন। একজনের এক হাতে মাইক্রোফোন আর এক হাতে ঘুরাচ্ছেন হুইল চেয়ারের চাকা। অন্য তিনজনও দুই হাতে হুইল চেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে মঞ্চে বিচরণ করছেন। এদৃশ্য বেশ দূর থেকেই চোখে পড়ে।

মঞ্চের কাছে গিয়ে দেখা গেলো, তারা মূলত মঞ্চে ঘুরে ঘুরে সাউন্ড সিস্টেম ঠিক করছেন। খানিক বাদেই শুরু হবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা।

এসময় মঞ্চের সামনের দিকটা বেশ ফাঁকা, বেশির ভাগ চেয়ার খালি। সামনের দ্বিতীয় সারির বাম পাশে বসে আছেন তিন জন।

কথা বলে জানা গেলো, তারা সবাই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। একজন ফারহিম আনজুম সোহানা। তিনি তেজগাঁও কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। আরেক জন নাহিয়ান বুসরা। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে মাস্টার্স করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এছাড়া জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ওপর তিনি ছায়ানট থেকে গ্রেজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন। অন্যজন রাহুল। তিনি পড়েন ঢাকা কলেজে। এই তিনজনের কেউই শুধু শুনতে নয়, তারা এসেছেন সংগীত পরিবেশন করতে।

এদের মধ্যে সোহানার সাথে এসেছেন তার বড় বোন ফারিহা আনজুম স্বর্ণা। তিনি জানান, তারা এসেছেন বনশ্রী থেকে। কিছুক্ষণ পরেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হবে। তার বোন সোহানা সংগীত পরিবেশন করবেন। বোনকে নিয়ে প্রায় এরকম বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে হয়। সোহানা জানান, তিনি আজ বাপ্পা মজুমদারের একটি গান করবেন।

কথা বলতে বলতে সাড়ে ছয়টার দিতে শুরু হয় সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। দুই/এক মিনিটেই ফাঁকা চেয়ারগুলো নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ দখলে নিয়ে নেন। চেয়ার ফাঁকা তো দূরের কথা, দাঁড়ানোর জায়গারও অভাব দেখা দেয়।

শুরুর কিছু পর অতিথি হিসেবে মঞ্চে আসেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘তাদের পারফর্ম দেখে খুবই ইমপ্রেসড হয়েছি। তারা সমাজের কাছ থেকে কোনো করুণা চায় না। তারা চায় সমান অধিকার। আমাদের, রাষ্ট্রের, সকলেরই তাদের সেই সুযোগ করে দিতে হবে।’

এরপর মঞ্চে নৃত্য নিয়ে আসেন মিনু। মিনু হুইল চেয়ারে বসেই নৃত্য পরিবেশন করেন। এভাবে আরও একজন পরিবেশনার পর মঞ্চে আসেন সোহানা। নিজে নিজে যেতে পারেন না। বড় বোন হাতে ধরে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়ে আসেন। সোহানা পরিবেশন করেন বাপ্পা মজুমদারের 'দিন বাড়ি যাই' গানটি।

সোহানার সংগীত পরিবেশন করে মঞ্চ থেকে নেমে আবার নিজের আসনে আসার পর একজন পথশিশু একটি ফুল নিয়ে দিতে আসেন সোহানাকে। বিষয়টি অনেককেই অবাক করে। এসময় সোহানার বোন বলেন, ‘এই শিশুর ভালোবাসা সত্যি অবাক করেছেন। প্রতিবন্ধীদের প্রতি তার মত এমন মূল্যায়ন সমাজের অনেকেরই নেই।’

এরপর কালো চশমা চোখে মঞ্চে আসেন আরেক জন। রংচটা জিন্সের প্যান্ট…গানে দর্শক মাতান পুরোটা সময়। একে একে শারমিন তিনটি গানে দর্শক মাতিয়ে রাখেন। এমনি করে একে একে ১৩ জন প্রতিবন্দী দর্শকের মন মাতান। এছাড়া এক পর্যায়ে অতিথি হিসেবে মঞ্চে আসেন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী মেহরীন।

হুইল চেয়ারে বসে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন কাজী বিল্লাল।

২৮ তম আন্তর্জাতিক এবং ২১ তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস উপলক্ষে এ অনুষ্ঠান আয়োজন করে পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র (সিআরপি)। এতে সহযোগিতা করেছে ডাকসু ও পিডিএফ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

একপর্যায়ে মঞ্চে আসেন সিআরপির চিফ অ্যাডভাইজার শহিদুর রহমান, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নাজরানা ইয়াসমিন হীরা ।

তারা বলেন, ‘আমাদের দেশের উন্নয়নে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা কাজ করে যেতে চায়। আপনাদের সকল রকম কাজে প্রতিবন্ধী মানুষদের অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করুন। আজ যারা গান পরিবেশেন করবেন, তারা যদি অন্যত্র সুযোগ পান, তাহলে তারা তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারবে। প্রতিবন্ধীরা কারো করুনা নয়, তারা সুযোগ চান। তাদের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতের তাগিদ দেন তারা।

অন‌্য কাজে বা নিছক আড্ডা দিতে এসে যারা তৎক্ষনাৎ প্রতিবন্ধীদের পরিবেশনা দেখতে শুরু করেছে, শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠান দেখেছে অন‌্যরকম তৃপ্তি নিয়ে। তবে সব দর্শক এমন আয়োজনের প্রশংসা করেছেন, তেমনি নিজেরাও এই মানুষদের জন‌্য কিছু করার প্রত‌্যয় নিয়ে ফিরেছেন। ঢাকা/সাওন ও ইয়ামিন/সাজেদ