শিক্ষা

১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন কতটা সফল, যা বলছেন শিক্ষার্থীরা

১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস। ১৯৬২ সালের এ দিনটি ছিল বাঙালি জাতির জন্য গৌরবোজ্জ্বল দিন। ওই দিন পাকিস্তানি শাসন, শোষণ ও শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে শহীদ হন ওয়াজিউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, বাবুলসহ অনেকেই। তাদের স্মরণে এ দিনকে শিক্ষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

গৌরবোজ্জ্বল সেই দিন নিয়ে আজকের শিক্ষার্থীরা কী ভাবছেন, তা জানার চেষ্টা করেছেন রাইজিংবিডি ডটকমের নিজস্ব প্রতিবেদক রায়হান হোসেন।

ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের শিক্ষার্থী মো. রুহুল আমিন বলেছেন, ‘১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের করা শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে মারা যান কয়েকজন মেধাবী ছাত্র। ছাত্র-জনতা সেদিন অধিকার আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে শরিফ কমিশনের শিক্ষা সংকোচন নীতি প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছিল এ দেশের সূর্যসন্তানরা। পরে ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় গভীর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল এই শিক্ষা আন্দোলন। সেদিন ছাত্রসমাজই পালন করেছিল নতুন ইতিহাস নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা, যার ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত রয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আজ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা চরম সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সরকার যদিও বেশ কয়েকটি জায়গায় পরিবর্তন এনেছে, কিন্তু তা তেমন ফলপ্রসূ না। এর কারণ পর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার অভাব। আজ তরুণরা অনার্স/মাস্টার্স পাস করে চাকরির জন্য ঘুরছে। নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে উচ্চ শিক্ষার পরিধি বাড়ানো হচ্ছে, কিন্তু শিক্ষার মূলনীতি কতটুকু বাস্তবায়ন হয়? পত্রিকা খুললেই দেখি, তরুণদের মধ্যে চাকরি না পাওয়ার হতাশা। এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আগে পর্যাপ্ত গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এরপর শিক্ষানীতি প্রয়োগ করলে ভালো ফল বয়ে আনবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. আনিসুর রহমান বলেছেন, ‘পাঁচ দশক আগের এই আন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষায় বৈষম্য দূরীকরণ। আমরা কি তা পেরেছি? এখনও প্রত্যন্ত অঞ্চলের অভিভাবকেরা অর্থাভাবে সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে পারেন না। অনেক গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত নেই। শিশুশ্রম এখনও উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।’

তিনি বলেন, ‘শরিফ কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের বদলে পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করেছিল, যার প্রতিবাদে ছাত্ররা প্রাণ দিয়েছিল। কিন্তু এখনও কেন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা রাজনৈতিক দলের মতের বাইরে কথা বলতে পারেন না? তাহলে স্বায়ত্তশাসন কী? শরিফ কমিশনের সুপারিশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলা হয়েছিলো। তখন ছাত্ররা এর প্রতিবাদ করেছিল। ৫০ বছর পর দেখা যাচ্ছে, উল্টো ছাত্ররাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানাচ্ছে। আমার প্রশ্ন—আসলে আমরা কোন পথে হাঁটছি?’

ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মানজিদ বলেছেন, ‘১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল শিক্ষাকে সর্বজনীন অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনকে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে শিক্ষা আন্দোলন বাঁক ফেরানোর মতো ঘটনা। স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের মাত্র ২ মাসের মধ্যে শরিফ কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশন ১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট প্রতিবেদন পেশ করে। প্রস্তাবিত প্রতিবেদনে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে ছাত্রদের বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব ছিল।’

তিনি বলেন, ‘১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের প্রায় ছয় দশকে অনেক রাজনৈতিক উত্থান-পতন, সামাজিক ভাঙা-গড়া, অর্থনৈতিক বৈষম্য নানা রকম প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে দিয়ে দেশ ও জাতি এগিয়ে গেছে। স্বাধীনতার পরবর্তী ৫০ বছরে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আছে নানা অভিযোগ। তরুণ প্রজন্মের প্রত্যাশা— সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সরকার মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে করবে। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের ব্যপারে যেসব অপশক্তি গভীর যড়যন্ত্রে লিপ্ত, তাদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে।’