বিনোদন

বিদায় মাস্টার অব হরর

নাবীল অনুসূর্য : ৩০ আগস্ট, হরর ভক্তদের জন্য শোকের দিন হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে গেল। এই ৩০ আগস্ট, যে মারা গেলেন তার নাম মাস্টার অব হরর ওয়েস ক্র্যাভেন। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি ব্রেন ক্যান্সারে ভুগছিলেন। শেষমেশ ৭৬ বছর বয়সে এসে তাকে সেই ব্রেন ক্যান্সারের কাছেই পরাজিত হতে হল।যারা তাকে চিনতে পারেননি, তাদের জানিয়ে রাখা ভালো, গত কয়েক দশকের মধ্যে সাড়া জাগানো হরর সিনেমার অল্প কয়েকটি ফ্র্যাঞ্চাইজির দুটোরই স্রষ্টা এই ওয়েস ক্র্যাভেন। এ নাইটমেয়ার অন এল্ম স্ট্রিট ফ্র্যাঞ্চাইজিটি তার মস্তিষ্ক-প্রসূত। বিশেষত এই সিরিজের ফ্রেডি ক্রুগার চরিত্রটি তাকে বিশেষভাবেই খ্যাতি এনে দেয়। তবে প্রথম সিনেমার পর এই ফ্র্যাঞ্চাইজির আর কোনো সিনেমাই তিনি পরিচালনা করেননি। তবে কাহিনি রচনা করে কিংবা প্রযোজনার মাধ্যমে আগাগোড়াই ফ্র্যাঞ্চাইজির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আর স্ক্রিম ফ্র্যাঞ্চাইজির সবগুলো সিনেমার পরিচালনাই করেছেন তিনি।এই ওয়েস ক্র্যাভেনের ক্যারিয়ারের শুরুর গল্প বেশ মজার। আমেরিকার ওহিও অঙ্গরাজ্যের ক্লিভল্যান্ড শহরে জন্মান তিনি। পড়াশোনা শেষ করে হাত দেন শিক্ষকতায়। প্রথমে পেনসিলভানিয়ার ওয়েস্টমিনিস্টার কলেজে ইংরেজি, পরে নিউ ইয়র্কের পটসডামে ক্লার্কসন কলেজ অব টেকনোলজিতে পড়ান হিউম্যানিটিস। এরপরেই তার ক্যারিয়ারে এক বিশাল বাঁকবদল ঘটে। তিনি ম্যানহাটনে একটি পোস্ট-প্রোডাকশন কোম্পানিতে সাউন্ড এডিটর হিসেবে কাজ শুরু করেন। এর কিছুদিন পরেই তিনি টাকার হাতছানিতে চলে যান নীল ছবির জগতে। এবি স্নেক নামে তিনি পর্নোগ্রাফিক সিনেমায় কাজ শুরু করেন। তখন তিনি মূলত কাহিনি রচনা ও এডিটিংয়ের কাজ করতেন।খুব তাড়াতাড়িই অবশ্য তিনি হলিউডে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যান। ১৯৭২ সালে মুক্তি পায় তার পরিচালনার প্রথম সিনেমা দ্য লাস্ট হাউস অন দ্য লেফট। হরর জনরার অল্প বাজেটের সিনেমাটি ব্যবসায়িক সাফল্যেরও মুখ দেখে। এবি স্নেক নামে তিনি যে একটিমাত্র সিনেমা পরিচালনা করেছেন, তা অবশ্য এরও ৩ বছর পরের ঘটনা। ১৯৭৫ সালে এবি স্নেক-এর পরিচালনায় মুক্তি পায় দ্য ফায়ারওয়ার্কস ওম্যান। নিতান্ত টাকার প্রয়োজনে বানানো বি-গ্রেডের এই সিনেমাটিও সমসাময়িক পর্নোগ্রাফিক সিনেমার ধারায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তখন হলিউডে যাকে বলে পর্নোগ্রাফির সোনালি সময়। সে সময়ের এই ধারাকে পরে সমালোচকরা পর্নো চিক নাম দেন। সিনেমাটি সে বছরের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্নো চিক সিনেমা হিসেবেই আবির্ভূত হয়।এরপর অবশ্য নিয়মিতই প্রযোজক পেতে থাকেন ওয়েস ক্র্যাভেন। একের পর এক বানাতে থাকেন হরর সিনেমা— দ্য হিলস হ্যাভ আইস (১৯৭৭), স্ট্র্যাঞ্জার ইন আওয়ার হাউস (১৯৭৮), ডেডলি ব্লেসিং (১৯৮১), সোয়াম্প থিং (১৯৮২), ইনভাইটেশন টু হেল (১৯৮৪)। তবে তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৮৪ সালে— এ নাইটমেয়ার অন এল্ম স্ট্রিট। ক্র্যাভেনের হাত ধরে পর্দায় দেখা দেয় হরর সিনেমার অন্যতম বিখ্যাত চরিত্র ফ্রেডি ক্রুগার। চরিত্রটি এতটাই জনপ্রিয়তা পায়, চরিত্রটিকে ঘিরে গড়ে ওঠে হরর জনরার অন্যতম বিখ্যাত ফ্র্যাঞ্চাইজি। অবশ্য ফ্র্যাঞ্চাইজির আর একটিমাত্র সিনেমাই পরিচালনা করেন ক্র্যাভেন— নিউ নাইটমেয়ার (১৯৯৪)। তবে সবগুলোর কাহিনি রচনাতেই হাত দেন। ফ্র্যাঞ্চাইজির অন্য সিনেমাগুলো হলো— ফ্রেডিস রিভেঞ্জ (১৯৮৫), ড্রিম ওয়ারিয়র্স (১৯৮৭), দ্য ড্রিম মাস্টার (১৯৮৮), দ্য ড্রিম চাইল্ড (১৯৮৯), দ্য ফাইনাল নাইটমেয়ার (১৯৯১), ফ্রেডি ভার্সেস জ্যাসন (২০০৩), ফ্রেডিস রিটার্ণ (২০০৯) এবং এ নাইটমেয়ার অন এল্ম স্ট্রিট (২০১০)। এছাড়াও ফ্রেডি ক্রুগারকে নিয়ে দুটি হরর টিভি সিরিজও বানানো হয়— ফ্রেডিস নাইটমেয়ারস (৪৪ পর্ব) এবং নাইটমেয়ার ক্যাফে (৬ পর্ব)। দুটোতেই কাহিনি রচনায় কাজ করেছেন ক্র্যাভেন। চরিত্রটিকে নিয়ে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য শর্ট ফিল্মও বানানো হয়েছে— ফ্রেডি ভার্সেস গোস্টবাস্টার্স (২০০৪), ফ্রেডি ভার্সেস জ্যাসন ভার্সেস অ্যাশ (২০১১), ক্রুগার: অ্যানাদার টেল ফ্রম এল্ম স্ট্রিট (২০১৩), ক্রুগার: এ ওয়াক থ্রু এল্ম স্ট্রিট (২০১৪), ক্রুগার: দ্য স্ল্যাশার ফ্রম এল্ম স্ট্রিট (২০১৪), ফ্রেডি ক্রুগার: নাইটমেয়ার অন ভেপ স্ট্রিট (২০১৫)।ওয়েস ক্র্যাভেনের আরেকটি বিখ্যাত কাজ স্ক্রিম। কেভিন উইলিয়ামসনের চিত্রনাট্যে স্ক্রিম সিরিজের প্রথম সিনেমা মুক্তি পায় ১৯৯৬ সালে। এই সিনেমাও ক্র্যাভেনকে বিপুল সাফল্য এনে দেয়। একে একে সিরিজের ৪টি সিনেমা মুক্তি পায় যথাক্রমে ১৯৯৭, ২০০০ এবং ২০১১ সালে। প্রতিটি সিনেমাই পরিচালনা করেন ওয়েস ক্র্যাভেন। রটনা ছিল, সিরিজের পঞ্চম সিনেমার কাজও নাকি শুরু করতে যাচ্ছিলেন তিনি।এ সময়ে এই দুই হরর ফ্র্যাঞ্চাইজির বাইরেও তিনি বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য হরর সিনেমা পরিচালনা করেন— ডেডলি ফ্রেন্ড (১৯৮৬), দ্য সার্পেন্ট এন্ড দ্য রেইনবো (১৯৮৮), শকার (১৯৮৯), দ্য পিপল আন্ডার দ্য স্টেয়ার্স (১৯৯১), ভ্যাম্পায়ার ইন ব্রুকলিন (১৯৯৫), কার্সড (২০০৫), রেড আই (২০০৫), মাই সোল টু টেক (২০১০)। এছাড়াও কয়েকটি হরর টিভি সিরিজের বেশ কিছু পর্বও পরিচালনা করেন তিনি।মূলত সারাজীবন হরর জনরা নিয়ে কাজ করলেও, ক্যারিয়ারের শেষ দিকে এসে তিনি এই জনরার বাইরের দুটি সিনেমায় কাজ করেন। ১৯৯৯ সালে মেরিল স্ট্রিপকে নিয়ে বানান মিউজিক্যাল-ড্রামা মিউজিক অব দ্য হার্ট। আর ২০০৬ সালে কাজ করেন ২২ পরিচালকের প্রজেক্ট প্যারিস, আই লাভ ইউ-তে।বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের অধিকারী হরর সিনেমার এই মাস্টারের মৃত্যু ছুঁয়ে গেছে বিশ্বের সকল হরর ভক্তকেই। এমন কোনো হরর সিনেমার ভক্ত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যে তার দুই বিখ্যাত চরিত্রের একটিকেও পছন্দ করেন না। তবে মৃত্যুর পর ফ্রেডি ক্রুগারের মতো সত্যি সত্যিই তিনি মানুষের স্বপ্নে হানা না দিলেই ভালো! 

     

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ আগস্ট ২০১৫/নাবীল/শান্ত