বিনোদন

‘মেলায় যাইরে’ গানটি হলো যেভাবে

পয়লা বৈশাখ এলেই আমাদের কানে যে সুরটি ভেসে আসে তাহলো- ‘মেলায় যাইরে’। আজ থেকে ২৬ বছর আগে ফিডব্যাকের ‘মেলা’ অ্যালবামে গানটি প্রকাশিত হয়। তারপর জনপ্রিয়তার মাত্রা কতটা পেয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। গানটি সকলের জানা থাকলেও এ গানটি লেখার পেছনের গল্প অনেকেরই অজানা। এ গানটির নেপথ্যের গল্প নিয়ে লিখেছেন এ গানের রচয়িতা ও গায়ক মাকসুদুল হক।

 

প্রতি বছর বাংলা নববর্ষ আসলেই আমার কাছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেলে যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে বলা হয়, তা হলো আমার জনপ্রিয় ‘মেলায় যাইরে’ গানটি সৃষ্টির পেছনে মূল ঘটনাটি কী ছিল। ১৯৯০ সালে আমার সাবেক ব্যান্ড ফিডব্যাকের ‘মেলা’ অ্যালবামে প্রকাশিত হয় গানটি। ১৯৮৮ সালে গানটি লিখেছিলাম। এর কম্পোজ এবং রচনাও করেছিলাম আমি। ধীরে ধীরে ২৬ বসন্ত পার হয়ে গেলেও এখনো মানুষের মনের কুঠিরে রয়ে গেছে গানটি।

 

ষাটের দশকে আমি খুবই ছোট। তখন বাবা-মার সঙ্গে বৈশাখের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতাম। আমরা পূর্ব পাকিস্তানের অংশ ছিলাম। তখন বাংলা ভাষা এবং বাংলা সংস্কৃতি অত্যন্ত নগন্য এবং অ-ইসলামিক মনে করা হতো। ছায়ানটের আয়োজনে রমনা পার্কে বৈশাখির আয়োজন ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের প্রথম সংস্কৃতিক প্রতিরোধ। এটি ছিল আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী, সমৃদ্ধ এবং ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতিকে তুলে ধরার প্রয়াস।

 

এক হাজার থেকে পনের শ একই মনমানসিকতার মানুষ তাদের পরিবার এবং বন্ধুদের নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। তারা প্রত্যেকেই ছিলেন একে অন্যের পরিচিত। আয়োজক থেকে শুরু করে শিল্পী, মিউজিশিয়ান এবং দর্শক সকলেই ছিলেন পরিচিত মুখ এবং আমরা একে অন্যের সঙ্গে খুব স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলাম।

 

রমনা পার্কের বিশাল ফাঁকা মাঠটি আমরা যারা শিশু ছিলাম তাদের জন্য পিকনিক স্পটের মতো ছিল। আমরা শিশুরা খেলায় মেতে থাকতাম। অন্যদিকে আমাদের বাবা-মা ব্যস্ত থাকতেন ঠাকুর (যিনি নিষিদ্ধ ছিলেন, কারণ পাকিস্তান সরকার তার কাজ নিষিদ্ধ করেছিলেন), নজরুল এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক তারকা ব্যক্তিত্ব, পল্লীশিল্পী, নৃত্যশিল্পী এবং কবিতা আবৃত্তি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আমরা সেগুলোর কিছুই বুঝতাম না। যাইহোক শোষণের থাবার বাইরে পার্কের খোলা বাতাসে যারা আজও আছেন, তাদের মনে অন্যরকম আবহ তৈরি করে। এমনকি আমরা যারা শিশু ছিলাম এবং এগুলোর কিছুই বুঝতাম না তাদের মনের মধ্যেও এর গভীর ছাপ ফেলেছিল।

 

স্বাভাবিকভাবেই ১৯৭১ সালের বাংলাদশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ছায়ানটের আয়োজনে প্রতিবছর বিশাল অনুষ্ঠানে পয়লা বৈশাখ উদযাপন করা হয়। ছায়ানট যারা কিনা আমাদের স্বাধীনতার সংকটময় মুহূর্তে সংস্কৃতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।

 

এখনো প্রতি বছর পয়লা বৈশাখ পালিত হয় কিন্তু এখন মানুষের মধ্যে কোনো আনন্দ এবং উচ্ছ্বাস দেখা যায় না। এটি মানুষের কাছে একটি বিরক্তিকর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া হয় কিন্তু উপস্থিত মানুষের মাঝে তা নিয়ে কোনো অনুভূতি নেই। তারা চোখ বন্ধু করে, খুবই গুরুগম্ভীর থাকেন। তাদের মধ্যে কোনো হাসি বা উচ্ছ্বাস দেখা যায় না। কেউ তালিও দেন না কারণ এটি অনেকটা অনানুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ।

 

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে রমনায় যে সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো তাকে শুধু অনুষ্ঠান মনে হতো না, এটিকে বিশাল একটি মেলা ছিল। সমাজের বিভিন্ন স্তরের হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হতেন এখানে। নব্বইয়ের দশকে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থীরা ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র প্রচলন শুরু করেন।

 

ছোটবেলা থেকেই আমি খুব সুঠাম দেহের কিশোর ছিলাম। আমার মধ্যে ইউরোপ এবং আমেরিকার সংগীত এবং সংস্কৃতির প্রভাব ছিল। যা আমার বাবা-মা এবং ছায়ানটের অন্যান্য গুরুজনদের অত্যান্ত হতাশ করত। আমার লম্বা চুল, টি-শার্ট, ছেঁড়া এবং ময়লা লেভি বা র‌্যাংলার জিন্স এ ছাড়া স্বভাবের মধ্যে দাম্ভিক ভাব, শাসক এবং প্রশাসনের তোয়াক্কা না করা যেগুলো ছিল উডস্টোক জেনারেশনের বৈশিষ্ট্য। যা আমাদর এবং আমার প্রজন্মের মধ্যে ভালোভাবেই প্রভাব ফেলেছিল।

 

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা সংস্কৃতিতে বাংলা রক সংগীত বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার পর সংস্কৃতির প্রতিন্ধকতা থেকে আমরা মুক্তি পাই এবং এটি ‘বৈশ্বিক’ অবস্থায় পৌঁছায়। তবে আমাদের গুরুজনরা এ বিষয়ে তেমন খুশি হননি।

 

‘মেলায় যাইরে’ তৈরির কয়েক বছরের মধ্যে এটি ‘বাঙালি সংস্কৃতি’-কে যে সংকীর্ণভাবে দেখা হতো তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের রূপ নেয়। প্রশাসনের জন্য এ গানটি ছিল একটি চ্যালেঞ্জ। বাংলা নববর্ষ বলতে আমি বুঝি আনন্দ-উচ্ছ্বাস এবং এটি কোনোভাবেই জর্জিয়ান নতুন বছর ৩১ ডিসেম্বর রাতের চেয়ে কম নয়। মজা এবং হৈ-হুল্লোর বাঙালিদের কাছে নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের গ্রামীণ অঞ্চলে আমার জানা মতে যেখানে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ থাকে তাদের মনে মিশে আছে উৎসব। এর পরের সবই ইতিহাস।

 

টেকনিক্যাল দিক থেকে বিবেচনা করলে গানটি বৈশাখি গানে একটি উচ্চ মাত্রা যোগ করেছে এবং বাংলাদেশের সংগীতের অগ্রগতিতে  বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। পাশাপাশি এখানে চারটি ইন্দ্রিও কাজ করে, যেমন : শোনা-গানটির শুরুতেই ঢাক, ঢোল, একতারা, মন্দিরা, দোতারা, বাঁশি পাশাপাশি পাশ্চাত্যের সংগীত যন্ত্র; দেখা- পলাশ, শিমুল, বাসন্তি শাড়ি, খোঁপা এবং তীব্র সূর্যের আলো যেমন মঙ্গল শোভাযাত্রা। গন্ধের ক্ষেত্রে- গ্রামের নারীরা রোমান্সের সময় বিদেশি সু-গন্ধির চেয়ে জেসমিন ফুলের গন্ধ বেশি পছন্দ করেন। স্পর্শের অনুভূতি- দোলা অথবা সবাই মিলে হাত ধরে নাচানাচি করা। এ গানে শুধু একটি অনুভূতি প্রকাশ করা হয়নি, আর তা হলো স্বাদের অনুভূতি। বাংলাদেশের মতো একটি গরীব দেশ, যারা নিজেরাই নিজেদের উৎসব সাজিয়ে তোলে, মাঝে মাঝে বছরের প্রথম দিনও তারা পেট পুরে খেতে পায় না।

 

অবশ্যই গানে একটি সতর্কবার্তা রয়েছে তা হলো- ‘বখাটে ছেলে’ অথবা গুণ্ডা যারা মেয়েদের বৈশাখে উত্যক্ত করে। নব্বইয়ের দশকেই প্রথম ‘লিঙ্গ স্পর্শকাতরতা’ ‘ইভ টিজিং’ এবং ‘যৌন হয়রানি’ শব্দগুলো মানুষের সামনে আসে কিন্তু তখন এগুলো তেমন ভীতির কারণ ছিল না যতটানা আজ হয়েছে। অবাক হওয়ার বিষয় ১৯৯৩ সালে গানটি প্রকাশের তিন বছর পর আমরা প্রথম কোনো পাবলিক অনুষ্ঠানে নারী লাঞ্ছনার প্রতিবেদন পড়েছিলাম। এরপর সময় গড়িয়েছে, তবে ২০১৫ সালের বৈশাখে নারী লাঞ্ছনার বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে হতাশ করেছে এবং পীড়া দিয়েছে।

 

পরিশেষে বলা যায়, ‘মেলায় যাইরে’ গানটি সাফল্যের সবটুকু কৃতিত্ব তাদের যারা গানটি শুনেছেন, যারা গানটিকে ভালোবেসে আমাদের সংস্কৃতির একটি অংশ বানিয়েছেন। বিশেষ করে তারা যারা এখনো সকল নেতিবাচকতা, আমাদের সকল ভয়, বাধা এবং সংশয় দূর করে ভালো কিছু হওয়ার বিশ্বাস করেন। আর এটিই বিশ্ব সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আমাদেরকে অর্থাৎ বাঙালিদের  সবচেয়ে গর্বিত, উজ্জ্বল, সহনশীল এবং বুদ্ধিমান জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।  

 

অনুলিখন : মারুফ খান

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ এপ্রিল ২০১৬/শান্ত