বিনোদন

‘যে ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করেছিলাম সে ইন্ডাস্ট্রি এখন অন্ধ’

রাহাত সাইফুল : বাংলা চলচ্চিত্রের জীবন্ত কিংবদন্তী নায়করাজ রাজ্জাক।  তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অসংখ্য জনপ্রিয় সিনেমা উপহার দিয়েছেন। এক সময় এ অভিনেতা চলচ্চিত্রাঙ্গন দাপিয়ে বেড়ালেও এখন আর তাকে চলচ্চিত্রের পর্দায় দেখা যায় না। 

 

১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উত্তাল সময়ে নতুন জীবন গড়তে একজন সাধারণ মানুষ আবদুর রাজ্জাক স্ত্রী ও শিশু সন্তান বাপ্পাকে নিয়ে ঢাকা এসেছিলেন। জীবন সংগ্রামের পর সফল হয়ে আজকের ‘নায়করাজ’ উপাধি পেয়েছেন| এটা যে কারো কাছে গল্প বলে মনে হতে পারে। রাজ্জাক অসীম মনোবল, কঠোর পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছেছেন।

 

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে রাইজিংবিডির বিনোদন বিভাগের সঙ্গে কথা হয় এ অভিনেতার। আলাপচারিতার বিশেষ অংশ নিয়ে সাজানো হয়েছে এই সাক্ষাৎকার।

 

রাইজিংবিডি :  কেমন আছেন?

রাজ্জাক : ষাট বছর চলচ্চিত্রে কাজ করেছি। এখন আমি বিশ্রামে আছি।  শারীরিক দিক থেকে ভালো আছি।  মানসিকভাবে ভালো নেই। এই যে ঈদ আসছে-  ঈদের সময় চলচ্চিত্রের রমরমা ব্যবসা হয়। কিন্তু আমাদের শিল্পীরা বেকার বসে আছে। সে দিক থেকে ভালো নেই।  যে ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করেছিলাম সে ইন্ডাস্ট্রি এখন অন্ধ। সেখানে মারামারি, হানাহানি চলছে। আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সবার কাছে দোয়া চাচ্ছি- ইন্ডা্স্ট্রি যেন আবার ভালো হয়, সুদিন ফিরে আসে। আজকে আমাদের শিল্পীরা দুরবস্থায় আছে, বেকার হয়ে গেছে।  তাদের জন্য কিছু করা উচিৎ।

 

রাইজিংবিডি : শিল্পীদের জন্য আপনি কোনো উদ্যেগ নিয়েছেন কিনা?

রাজ্জাক : আমি এখন সুস্থ হয়েছি,  দেখা যাক- তাদের জন্য কিছু করা যায় কিনা। সবার কাছে আমি দোয়া চাচ্ছি আমার শরীর যেন আল্লাহ  ভালো রাখেন।  আপনাদের মাঝে আরো কিছুদিন যেন থাকতে পারি।

 

রাইজিংবিডি : ঈদুল আজহায় আপনার প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাই।

রাজ্জাক : এখন আর ঈদের প্রস্তুতি নিয়ে ভাবি না। এ দায়িত্বটা এখন ছেলেদের কাঁধে তুলে দিয়েছি। ঈদের আনন্দ নাতি-নাতনিদের সঙ্গে শেয়ার করি। এছাড়া আমার বন্ধুদের অনেকেই বেঁচে নেই। যারা বেঁচে আছেন তাদের সঙ্গে টেলিফোন ও মোবাইলে কথা বলি।

 

রাইজিংবিডি : ‘নায়করাজ’খেতাবটিকেদিয়েছিলেন?

রাজ্জাক : আহমেদ জামান চৌধুরীসহ তখনকার সবাই আমাকে এ খেতাব দেন। সাংবাদিকদের অবদান আমার জীবনে কম নয়।  সাংবাদিক আহমেদ জামান চৌধুরীর সাথে ঝগড়া হয়েছে আবার কাঁধে হাত দিয়ে হেঁটেছি।

 

রাইজিংবিডি : চলচ্চিত্রের উন্নয়নে সংবাদ মাধ্যমের কতটা ভূমিকা থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

রাজ্জাক : চলচ্চিত্রে সংবাদমাধ্যম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। আমার পেশাজীবনে সাংবাদিকরা সবসময় আমার পেছনে লেগে থাকতো। আমার ‘গুষ্টি’ উদ্ধার করত। তারপর তারাই আবার আমাকে ‘আপনি নায়করাজ রাজ্জাক’ বলতো। আমার চারটা সিনেমা সিলভার জুবলি (টানা ২৫ সপ্তাহ হলে চলেছে) হওয়ার পর চিত্রালীতে ছোট করে প্রকাশিত হয়েছিল। শুটিং সেটে আধ ঘণ্টা দেরি করে উপস্থিত হলে নিউজ হতো। আর এখনতো ৬ ঘণ্টা দেরি হলেও কিছু বলে না। শুটিং শেষ করে ভোর ৫টায় বাসায় গিয়ে সকাল ৯টায় আবার শুটিং করেছি।  তখন সোনারগাঁওয়ের নাস্তা পাওয়া তো অনেক দূরের ব্যাপার ফার্মগেট থেকে নাস্তা আনিয়ে খেয়েছি।

 

রাইজিংবিডি : তখন এই ধরণের সমালোচনা কী স্বাভাবিকভাবেনিতেপারতেন?

রাজ্জাক : আমার ওস্তাদ জহির রায়হান বলেছিলেন, ‘যখন আপনার নামে সাংবাদিকরা কিছু লিখবে না তখন আপনার কোন মূল্য নেই।  যখন আপনার বদনাম করবে তখন বুঝবেন আপনার সুনাম আছে।  ভেবে নিবেন আপনি কিছু একটা করছেন।’ সকালে নেতিবাচক সংবাদ পড়ে এসে বিকালে সাংবাদিকের সঙ্গে খাতির করতাম। ভাই কেমন আছেন? কী করছেন? এসব আলাপ করেছি।

 

রাইজিংবিডি :  বর্তমানে আমাদের দেশে হুট করে নায়ক-নায়িকা বানিয়ে দিচ্ছেন পরিচালক-প্রযোজক। এ ক্ষেত্রে নায়ক-নায়িকাদের নির্দিষ্ট কোনো যোগ্যতার নীতিমালা হওয়ার প্রয়োজন আছে কি?

রাজ্জাক : এর দায়িত্ব পরিচালকদের। নীতিমালা করে শিল্পী বানানো যাবে না। উত্তম কুমারকে সেট থেকে বের করে দিয়েছিল। তিনি তার প্রতিভা দিয়ে প্রমাণ করেছেন তিনি কে? আজ আমি নায়করাজ রাজ্জাক। বিএফডিসির গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়ে আমাকেও তিনবার তাড়া খেতে হয়েছিল। আমি তখন নায়ক হতে আসিনি।  আমি কাজ চেয়েছিলাম। চলচ্চিত্রে আসার আগে আমি নাটকে কাজ করেছি। এটা ১৯৬৪ সালের কথা বলছি। আমি ২৫০টি  নাটকে অভিনয় করেছি।

 

একবার শুটিং সেটে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। প্রোডাকশন ম্যানেজার আমাকে বলে, এখানে বাইজির নাচ ঘরে বসে থাকার একটা ‘পাট’ আছে। কাজ করবেন?  আমি রাজি হলাম। এভাবে কাজে ঢুকেছি।  পরিচালক সাহেবদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। ‘কার বউ’  সিনেমায় বেবি ট্যাক্সির ড্রাইভারের চরিত্রে অভিনয় করেছি।  আমার কোনো ইগো ছিল না।  জহির রায়হান আমাকে ব্রেক দিয়েছেন। আমি পরিশ্রম করেছি টাকার দিকে তাকাইনি।

 

রাইজিংবিডি : সম্প্রতি যৌথ প্রযোজনায় সিনেমা নির্মিত হচ্ছে। এ বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

রাজ্জাক : এখন যৌথ প্রযোজনার নামে স্মাগলিং চলছে।  যৌথ প্রযোজনা হতে হলে দুই দেশের সমান অংশীদারিত্ব থাকতে হবে।  কিন্তু এখন যা হচ্ছে তা স্মাগলিং। অন্যদের সিনেমা আমাদের এখানে চালানো হচ্ছে। কিন্তু আমাদের চলচ্চিত্রকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। আমাদের সবার এখন বাংলাদেশের সিনেমার পাশে দাঁড়ানো উচিত।

 

রাইজিংবিডি : আপনি কি বর্তমান সময়ে নির্মিত যৌথ প্রযোজনার সিনেমা দেখেন?

রাজ্জাক : একদিন যৌথ প্রযোজনার একটি সিনেমার গান দেখছিলাম। নায়িকার পোশাক এত ছোট ছিল যে আমার স্ত্রী বলল, তুমি এসব দেখছো? তখন বললাম, আমাদের বাচ্চারা কী করছে দেখতে হবে না। কলকাতার অনেকে আমাকে বলেন, আমাদের দেশের নায়িকারা নাকি সেখানে অশ্লীলতা করছে। তখন তাদের আমি বলি, তোমরা যাদের বাংলাদেশের নায়িকা বলছ তাদের বাংলাদেশের তেমন কেউ চেনেই না। বি অথবা সি গ্রেডের নায়িকা এরা। এখনো তারা নিজের দেশে ঠিকমতো নায়িকা হয়ে উঠতে পারেনি। তাই তোমাদের ওদিকে গিয়ে এমন করছে। আর তোমাদের দেশের প্রতিষ্ঠিত নায়িকারাই বাংলাদেশে এসে অশ্লীলতা শুরু করেছিল। মূলকথা, আমাদের চলচ্চিত্রকে ধ্বংস করার জন্যই এসব হচ্ছে। আমাদের  সম্মিলিত উদ্যোগই পারে চলচ্চিত্রকে টিকিয়ে রাখতে।

 

রাইজিংবিডি : ইদানিং ভারতীয় সিনেমা বাংলাদেশে মুক্তি দেয়া হচ্ছে। এটা আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য কতটা সুফল বয়ে আনবে বলে মনে করছেন?

রাজ্জাক : আমাদের ইন্ডাস্ট্রি বাঁচাতে হলে যৌথ কিংবা ভারতীয় সিনেমার দরকার নেই। দেশিয় সিনেমাই যথেষ্ট। আমাদের উচিত বাংলাদেশের সিনেমার পাশে দাঁড়ানো। যখন অনেকগুলো চ্যানেল এলো তখন আমরা ‘রূপবান’, ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ দিয়ে ইন্ডা্স্ট্রি চালিয়েছি।  যখন মুখ থুবড়ে পরল ইন্ডাস্ট্রি  তখন ‘বাবা কেন চাকর’ দিয়ে  চালিয়েছি। চেষ্টা করতে হবে।

 

রাইজিংবিডি : চলচ্চিত্রের জন্য সরকার অনুদান দিচ্ছে। সরকারি অনুদানে বেশ কিছু সিনেমা নির্মিত হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার ভাবনা জানতে চাই।

রাজ্জাক : সরকারি অনুদানের পদ্ধতিটা সঠিক হচ্ছে না।  ভালো মানের সিনেমা নির্মাণ করতে হলে বাজেট বাড়াতে হবে।  আর যাদের অনুদান দেয়া হচ্ছে তারা সবাই পরিচালক নয়।  মুখ দেখা লোক। ভালো গল্প দিয়েছেন এমন লোকদের অনুদান দেয়া হচ্ছে না। অনুদানের অনেক সিনেমা আছে যা মুক্তিই পাচ্ছে না। টাকা নিয়েই শেষ।

 

রাইজিংবিডি : সেন্সরবোর্ডের সদস্যসহ চলচ্চিত্রের বিভিন্ন কাজের সঙ্গে বিভিন্ন সময় জড়িত থেকেছেন। এই মুহুর্তে চলচ্চিত্র যেভাবে চলছে তা কতটা আমাদের চলচ্চিত্রের পক্ষে যাচ্ছে বলে মনে করছেন?

রাজ্জাক : আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চলচ্চিত্রের ব্যাপারে খুব আগ্রহী।  যখনই তার সঙ্গে আমার কোনো অনুষ্ঠানে দেখা হয় তখনই  তিনি আমাকে চলচ্চিত্রের কথা জিজ্ঞেস করেন।  সর্বশেষ গত রোজার ইফতার পার্টিতে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কী হচ্ছে আপনাদের ইন্ডা্স্ট্রিতে?  আমি টাকা দিচ্ছি আপনারা খরচ করতে পারছেন না?  তারপর বললেন, আপনি আসেন, কথা বলেন।

 

আমি চলচ্চিত্রের অনেককেই বলেছি-  চলেন আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করি।  শুধু সরকারি টাকা দিয়ে তো এ ইন্ডা্স্ট্রি চালানো যাবে না।  আমরা জায়গা-জমি বন্ধক রেখে, ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়ে সিনেমা মুক্তি দিয়েছি। এখন সরকার অনেক সুবিধা দিয়েছেন। অনুদান দিচ্ছেন। সরকারের যথেষ্ট সহযোগিতা রয়েছে। সরকারও ভালো কিছু করতে চাচ্ছেন। আমরাই ভালো কিছু করতে পারছি না। সরকারকে তো আমরাই বলতে পারছিন না, এটা আমরা করব।

 

রাইজিংবিডি : বর্তমান চলচ্চিত্রের অবস্থা কেমন যাচ্ছে বলে মনে করছেন?

রাজ্জাক : আমি যখন কাজ করেছি তখন সব ফ্লোরে কাজ চলছিল। পরিচালক, শিল্পীরা কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এখন ল্যাব বন্ধ কাজ নেই। সাউন্ড বন্ধ কাজ নেই।  পরিচালক-শিল্পীরা বেকার।  আমি টপ ফ্লোরে গিয়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখি সব ফাঁকা। চলচ্চিত্রের যেদিকেই তাকাই শুধুই হাহাকার। কণ্ঠশিল্পী থেকে শুরু করে সবারই হাহাকার।

 

রাইজিংবিডি : চলচ্চিত্রের এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী বলে মনে করছেন?

রাজ্জাক : বর্তমানে চলচ্চিত্রের মন্দাভাব নিরসন ও সমস্যাগুলোর প্রতিকারের জন্য চলচ্চিত্রাঙ্গনের অনেকে আমার কাছে পরামর্শের জন্য আসেন। আবার অনেকে আন্দোলনের কথাও বলেন। মাঝে মাঝে দেখি আন্দোলনও হচ্ছে। কিন্তু ফল নেই। যেকোনো মূল্যে দাবি আদায় করে নিতে হবে। যদি ভালোভাবে আন্দোলন করা যায় তাহলে দাবি আদায় সম্ভব। আমাদের সময় আমরাও আন্দোলন করেছি। তখন আমরা সংখ্যায় লোকও কম ছিলাম। আমরা তখন মারও খেয়েছি। শুধু মুখে আন্দোলনের কথা বললে কোনো লাভ নেই।  আমি বলছি,  আপনারা ভালোভাবে আন্দোলন শুরু করুন।  আমি আপনাদের সাথে আছি।  প্রয়োজনে মার খেতে রাজি আছি।

 

রাইজিংবিডি : রাইজিংবিডিকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

রাজ্জাক : আপনাকেও ধন্যবাদ।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬/রাহাত/শান্ত